সোমবার, ১ জুলাই ২০২৪

দেশপ্রেম ও ইসলাম

আপডেটেড
২৯ জুন, ২০২৪ ১১:২৫
সৈয়দ এনাম-উল আজিম
প্রকাশিত
সৈয়দ এনাম-উল আজিম
প্রকাশিত : ২৯ জুন, ২০২৪ ১১:২৫

ইসলাম যেমন শান্তি ও মানবতার ধর্ম তেমনি দেশপ্রেমও ইসলামের একটি প্রধান আদর্শ। ইসলামের বিজয়লগ্ন থেকেই সারা পৃথিবীজুড়ে মুসলমানরা দেশপ্রেমের যে উদাহরণ রেখে গেছেন, তা সর্বকালেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আরব মরুভূমি থেকে সারাজাহানে ইসলামের অদম্য জয়যাত্রা সে তো দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুসলিম সেনানি আর সেনাপতিদের মহান বিরত্বেই। নিজের ভূখণ্ডকে যে ভালোবাসে সে তার সম্প্রসারণ ও সমৃদ্ধিতেও বিশাল অবদান রাখতে পারে। যার ভেতর কোনো দেশপ্রেম নেই তার দ্বারা অন্তত দেশের কোনো উন্নতি আশা করা যায় না। পৃথিবীর সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠী তাদের বৃদ্ধি, সংহতি ও উন্নতির জন্য যা করেছে তা সবই দেশপ্রেম বা জাতিবোধ থেকেই নিঃসরিত। আর তাই ইসলাম দেশপ্রেমকে উৎসাহিত করেছে। ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে-হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান অর্থাৎ দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ।

ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই ইসলামের মনীষীরা স্বদেশ ও স্বজাতিকে নিজের সন্তান-সম্পদের মতো ভালোবাসতেন। স্বদেশ আর স্বজাতিকে ভালোবাসতে গিয়ে মহামূল্য জীবন উৎসর্গ করার ঘটনা ইসলামে অসংখ্য। অধিকার আদায় এবং ইসলামি সালতানাত সুরক্ষা করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) সপরিবারে শহীদ হওয়ার ঘটনা সারা পৃথিবীর মানুষ জানে। কারবালার যুদ্ধ ছিল দেশ ও ধর্মরক্ষা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত বিদ্রোহ। ওমর বিন আব্দুল আজিজ, মুহাম্মদ বিন কাশিম, সাইয়েদ আহমেদ, মীর নিসার আলী তিতুমীর, টিপু সুলতানসহ অসংখ্যা বীর ও মুসলিম নেতা শহীদ হয়েছেন দেশের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সুরক্ষার জন্য। আমাদের মহানবী (স.) ছিলেন দেশপ্রেমের অনন্যা উদাহরণ। জন্মভূমি মক্কা নগরীর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অন্তহীন। মহানবীকে যখন মক্কার প্রতিপক্ষের লোকেরা চরম নিষ্ঠুরতা আর প্রতিহিংসা প্রদর্শনপূর্বক মক্কা ছেড়ে যেতে বাধ্য করল, তখন তিনি মদিনার পথে যাচ্ছিলেন আর প্রিয় জন্মভূমি মক্কার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন হে মক্কা! ভূখণ্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম। আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের না করে দিত তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না। (জামে তিরমিজি, হাদিস: ৩৯২৬)।

দেশপ্রেম ও সাম্রাজ্য বৃদ্ধিতে মুসলমানদের কৃতিত্ব যুগে যুগে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। দেশপ্রেমিকদের করেছে অনুপ্রাণিত। দেশপ্রেমে বলিয়ান বলেই ফিলিস্তিনিরা বর্বর ইসরায়েলিদের সঙ্গে স্বাধীন ফিলিস্তিনের জন্য জীবন দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারছে তবুও ভূখণ্ড ছেড়ে দিচ্ছে না। পরাশক্তি পারছে না ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরান বা আফগানিস্তানকে কবজা করতে। পারেনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ঠেকিয়ে রাখতে। দেশপ্রেম আছে বলেই পুরো বাংলাদেশের জনগণ এক ও অভিন্ন। রাজনৈতিক মতভেদ যতই থাকুক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ।

আমাদের পবিত্র কোরআন ও হাদিসে দেশপ্রেমকে অগ্রাধিকার দিয়েছে বলেই ইসলামি শক্তিকে ইসলামবিরোধী পরাশক্তিগুলো মারাত্মক ভয় পায়। তাই দেখা যায়, যখনই কোনো মুসলিম দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান জননন্দিত বা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তখনই তাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে বা ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যা, লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফী, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের হত্যা সেই ষড়যন্ত্রেরই বহির্প্রকাশ। সিরিয়ার এরদোগানকে, ইরানের খোমেনিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে ইহুদীদের চরম প্রতিহিংসা। ইসলামে দেশপ্রেমের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে দুনিয়াব্যাপী মুসলিমরা দেশ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় আজ আপসহীন। মহান আল্লাহ সুরা নিশার ৫৯নং আয়াতে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কর এবং ন্যায়পরায়ণ শাসকের আদেশ মেনে চল।’ আল্লাহ পবিত্র কোরআনে আরও ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। আর তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাবান সে যে আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করে। (সুরা হুজুরাত, আয়াত-১২)।

ইসলামে দেশপ্রেম ও সবার প্রতি ভালোবাসার অনবদ্য নির্দেশনা রয়েছে মহানবীর বিদায় হজের ভাষণে। সেখানে নবী (স.) পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দেন, জেনে রেখ তোমাদের প্রতিপালক একজন। পিতা একজন। আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই । সাদার ওপর কালার, কালার ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই । তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে একজন আরেক জনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে। (মুসনাদে আহাম্মদ-৫/৪১১)

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাকওয়ার ওপর থাকা এবং অন্তরে, কথায়, আচরণে দেশপ্রেম অটুট রেখে দেশ ও জাতির সেবা করার তৈফিক দিন। আমিন।

লেখক: ইসলামিক কলামিস্ট


রাসেলস ভাইপার যত না মারাত্মক তার চেয়ে গুজব ও আতঙ্ক বেশি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

আমরা বাঙালি জাতির নানারকম কর্মকাণ্ডে অপসংস্কৃতির আড়ালে গুজব বেশ জায়গাজুড়ে আছে। বর্তমান অত্যাধুনিক যুগে এ গুজবের বেড়াজাল থেকে এখনো আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। এমনকি বর্তমানে এ সাপকে নিয়ে প্রায় জনপদে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বস্তুত গুজবের কারণে যতখানি লাভ হয়, তার চেয়ে ক্ষতি হয় অনেকগুণ বেশি। এই তো বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে এরকম একটি বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপারের গুজবের শেষ নেই। তাই একান্ত বাধ্য হয়ে কাগজ-কলম হাতে তুলে নিয়েছি।

উল্লেখ্য, চন্দ্রবোড়ার ইংরেজি নাম রাসেলস ভাইপার। এটি আমাদের উপমহাদেশে কম বেশি আগেও ছিল, এখনো আছে এবং আগামীতেও থাকবে। আর এই চন্দ্রবোড়ার নাম রাসেলস ভাইপার (Daboia Russelii), hv Viperidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মজার ব্যাপার হলো- আগে এর নাম রাসেলস ভাইপার ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে ১৭৯৭ সালের দিকে জর্জ শ এবং ফ্রেডেরিক পলিডোর নোডার নানা সাপ নিয়ে গবেষণার করার প্রাক্কালে এই সাপ চিহ্নিত করেছিলেন। আর এ ক্ষেত্রে নামকরণের দিক দিয়ে প্যাট্রিক রাসেলস নামে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা স্যার প্যাট্রিক রাসেল এই উপমহাদেশের সাপের শ্রেণিবিন্যাসের বা ক্যাটালগিংয়ের কাজ শুরু করেন ১৭০০ সালের শেষের দিক থেকে। এ ব্যাপারে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আর তিনি এ অঞ্চলের অনেক সাপের পরিচিতি এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তার মধ্যে চন্দ্রবোড়াও ছিল। তাই আঠারো শতকে সাপের চূড়ান্ত শ্রেণিবিন্যাসের সময় প্যাট্রিক রাসেলস নিঘুর্ম ও অক্লান্ত কার্যক্রমের সুবাদে সতীর্থ বিজ্ঞানীরা এগিয়ে আসেন এবং তার নামজুড়ে দেয় এই সাপটির সঙ্গে। আর সেই থেকে চন্দ্রবোড়া হয়ে ওঠে রাসেলস ভাইপার।

অনেকে বলে থাকেন, এটা পৃথিবীর পঞ্চম বিষধর সাপ। কথাটা পুরাপুরি সঠিক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষের মারাত্মকতার দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক রেটিংয়ের অবস্থান আরও অনেক নিচে। এমনকি বিষধর প্রথম ৩০টি সাপের মধ্যেও এর স্থান নেই। উল্লেখ্য, গোখরা সাপ কামড়ালে চিকিৎসা না নিলে গড়ে ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে গড়ে ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়ার কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পরে রোগীর মৃত্যু হলেও হতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, চন্দ্রবোড়া কামড়ালে রোগীর অন্য কোনো অসুস্থতা না থাকলে ৭২ ঘণ্টার আগে রোগী অতি সহজে মারা যায় না। বাংলাদেশে এই সাপের কামড়ের পর ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ড পর্যন্তও আছে। আর রাসেলস ভাইপার কামড়ালে যা করণীয়। সে ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করতে হবে যে সাপের কামড় মানেই মৃত্যু নয়। কামড়ানোর স্থান থেকে বিষ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কামড়ানোর অব্যবহিত পর স্থির করতে হবে যে পায়ে কামড় দিলে বসে পড়তে হবে। হাত বা অন্য অংশে কামড় দিলে সে অংশ নড়ানো যাবে না। চিকিৎসক বা হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে এই ব্যান্ডেজ কোনোভাবেই খোলা যাবে না। হাতে বা পায়ে চুড়ি, আংটি বা নূপুর বা আচ্ছাদিত পোশাক থাকলে রাসেলস ভাইপার সর্বোচ্চ দেহ ও লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫ ইঞ্চি। এই চন্দ্রবোড়ার মাথা চ্যাপ্টা, ত্রিভুজাকার এবং ঘাড় থেকে আলাদা। থুতু ভোঁতা, গোলাকার এবং উত্থিত। নাকের ছিদ্র বড়, প্রতিটির একটি বড়, একক অনুনাসিক স্কেলের মাঝখানে। অনুনাসিক স্কেলের নিচের প্রান্তটি নাসোরোস্ট্রাল স্কেলে স্পর্শ করে। এর সুপ্রাণসাল স্কেল একটি শক্তিশালী অর্ধচন্দ্রাকার আকৃতি ধারণ করে এবং নাসালকে নাসোরোস্ট্রাল স্কেল থেকে পূর্বের দিকে আলাদা করে। রোস্ট্রাল স্কেল যেমন বিস্তৃত তেমনি এটি উচ্চ। মাথার মুকুট অনিয়মিত, দৃঢ়ভাবে খণ্ডিত দাঁড়িপাল্লা দিয়ে আবৃত বলে প্রতীয়মান হয়। সুপ্রাওকুলার স্কেলগুলো সরু, একক এবং মাথাজুড়ে ছয় থেকে নয়টি দাঁড়িপাল্লার মতো চিহ্ন দ্বারা বিভক্ত। চোখ বড়, হলুদ বা সোনালি রং দিয়ে ঘেরা, এবং ১০-১৫টি বৃত্তাকার আঁশ দিয়ে ঘেরা। সাপের ১০-১২টি সুপারলাবিয়াল আছে, যার মধ্যে চতুর্থ এবং পঞ্চমটি উল্লেখযোগ্যভাবে বড়। আর তিন বা চার সারি সাবকোকুলার দ্বারা চোখ সুপ্রালাবিয়াল থেকে আলাদা।

রাসেলস ভাইপার ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল এবং পাকিস্তানে দেখা যায়। অবশ্য পূর্বে এই প্রজাতির জন্য নির্ধারিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ভিন্ন প্রজাতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যা Daboia siamensis বলে অভিহিত ছিল। অনেকে আবার এই প্রজাতিকে লোকালি ‘ভারত’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে থাকে। এ প্রজাতি পাঞ্জাবে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এটি গঙ্গা উপত্যকা, উত্তরবঙ্গ এবং আসামেও দেখা যায়। রাসেলস ভাইপার কোনো নির্দিষ্ট আবাসস্থলে সীমাবদ্ধ নয়। এ সাপ বেশির ভাগই খোলা, ঘাসযুক্ত বা ঝোপঝাড় বা বনবাদাড়ে পাওয়া যায়। এ ছাড়া বাগান ও কৃষি জমিতেও দেখা যায়। এটি সমভূমি, চরাঞ্চল, উপকূলীয় নিম্নভূমি এবং পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত বছরের প্রথম দিকে সঙ্গম করতে দেখা যায়, গর্ভাবস্থার সময়কাল ছয় মাসের বেশি। আর যৌন পরিপক্বতা হতে ২ থেকে ৩ বছর সময় লাগে। এই সাপ একসঙ্গে ন্যূনতম ১১টি বাচ্চার জন্ম দিয়ে থাকে। রাসেলস ভাইপার ইঁদুর, টিকটিকি, সরীসৃপ, ভূমি কাঁকড়া, বিচ্ছু ইত্যাদি খেয়ে থাকে।

সাধারণত কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা শুরু হয় এবং আক্রান্ত স্থান ফুলে যায়, রক্তপাতও হয়। এদিকে রক্তচাপ কমে যায়, হৃদস্পন্দন কমে যায়। এদিকে কামড়ের স্থানে ফোসকা দেখা দেয়। গুরুতর ক্ষেত্রে আক্রান্ত অঙ্গ বরাবর বিকাশ লাভ করে। সব ক্ষেত্রে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে বমি ও মুখের ফোলা দেখা যায়। কিডনি ব্যর্থতাও (রেনাল ফেইলিওর) লক্ষণীয়। গুরুতরভাবে ছড়িয়ে পড়া ইন্ট্রাভাসকুলার জমাটবদ্ধতাও মারাত্মক বিষক্রিয়ায় ঘটতে পারে। তীব্র ব্যথা ২-৪ সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে। টিস্যু ক্ষতির স্তরের ওপর নির্ভর করে এটি স্থানীয়ভাবে অব্যাহত থাকতে পারে। প্রায়ই, ৪৮-৭২ ঘণ্টার মধ্যে স্থানীয়ভাবে ফুলে ওঠে। পেশি টিস্যুতে লাল রক্তকণিকা এবং প্লাজমা ফুটো হওয়ার কারণে ফুলে যাওয়া জায়গাজুড়ে বিবর্ণতা ঘটতে পারে। আর দুই সপ্তাহের মধ্যে সেপ্টিসেমিয়া বা কিডনি, শ্বাসযন্ত্র বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে।

রাসেলস ভাইপারের আতঙ্ক নিয়ে সারা বাংলাদেশের লোক নির্ঘুম রাত দিন কাটাচ্ছে। আর সে ব্যাপারে বাস্তবে কতগুলো উদাহরণ তুলে ধরছি- এতে অযথা আশঙ্কা হয়তো তেমন আর থাকবে না।

ঘটনা এক- গত বছর ৩ জুলাই সোমবার সকালে পদ্মার চরে (রাজবাড়ী জেলার পাংশা সুর চরপাড় এলাকা) পাটখেতে নিড়ানি দিতে গিয়ে জাহিদুল (৩৫) সাপের কবলে পড়েন। তাকে চন্দ্রবোড়া কামড় দিলে সাপটিকে মেরে, মরা সাপসহ তাকে অন্য কোথাও না নিয়ে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। কুষ্টিয়ার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে যান। অনেকে এই সাপটি রাসেলস ভাইপার বলে অভিহিত করেন।

ঘটনা দুই- গত ৫ মার্চ মঙ্গলবার সকালে পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে চন্দ্রবোড়ার ছোবলের শিকার হন তারিকুল ইসলাম (বাড়ি কল্যাণপুর, শিলাইদহ ইউনিয়ন, উপজেলা কুমারখালী)। তরিকুলের ডান পায়ে সাপ কামড় দিলে তিনি তার সাথীদের বিষয়টি জানাতে একটু সময় নেন। বন্ধুরা আক্রান্ত স্থানে রশি দিয়ে বেঁধে দেন। তাদের ধারণা ছিল, এতেই কাজ হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে স্থানীয় লোকজন তাকে তার বাড়ি নিয়ে যান। এরপর পরিবারের লোকজন তাকে কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। ততক্ষণে প্রায় সাত-আট ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেছে। পরদিন বুধবার তাকে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে তার মৃত্যু হয়।

ঘটনা তিন- একই জাতের সাপের কামড়ের দুজন রোগী একই হাসপাতালে ভর্তি হয়। একজন সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরেন, আরেকজনকে বাঁচানো যায় না। আসলে সময় এখানে প্রধান বিষয় (Time is a big factor) হিসেবে কাজ করেছে। প্রথমজন সাপে কাটার ১৯০ মিনিট অর্থাৎ ৩ ঘণ্টা ১০ মিনিটের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে পেরেছেন; কিন্তু আরেকজন হাসপাতাল থেকে তুলনামূলকভাবে কম দূরত্বে থেকেও অবহেলা করে সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি। বস্তুত সাপে কামড়ানোর চিকিৎসায় প্রথম ১০০ মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে ১০টি অ্যান্টিভেনম নিতে হয়। এ প্রেক্ষাপটে একজন তরুণ চিকিৎসক তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি নিজে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি করার সময়ে কম করে হলেও চারজন চন্দ্রবোড়া কামড়ের রোগীকে সুস্থ করেছি।’ আসলে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা নিয়ে অধিকাংশ রোগী ভালো হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, সাপের কামড়ে বেশি শিকার হন কৃষকরা চর এলাকায়। তা ছাড়া বর্ষাকালে এসময় সাপের উপদ্রব বেশি হয়ে থাকে।

ইদানীং এমন অবস্থা দেখা গিয়েছে, সাপ দেখলেই আর কথা নয়, মারতে হবে। গুজবের নামে এখন সব রকম মারার হিড়িক চলছে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (২০০৮-০৯) এবং দেশের প্রখ্যাত সর্প দংশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ মনে করেন, চন্দ্রবোড়া নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দিতে পারলে বিষক্রিয়া থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, অধ্যাপক ফয়েজ ১৯৭৮ সাল থেকে সর্প দংশনের ওপর গবেষণা করে আসছেন। তার মতে, মানুষ এখনো কুসংস্কার কেটে উঠতে পারেনি। সাপে কামড়ালে আর কথা নয়, ওঝার কাছে ছুটে যায়। অহেতুক সময় নষ্ট করার কারণে তাই মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয় না।

পূর্বেই বলেছি, সাপ স্থূল ও সূক্ষ্মভাবে এ আজব প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। আমরা কেবল স্থূলটি দেখতে পারি। সূক্ষ্ম বিষয়টি আমাদের জানার বাইরে, যা কেবল প্রকৃতিই জানে। যা হোক, সাপ নিরীহ প্রাণী। আঘাত না করলে কামড় দেয় না। সাপ দেখলেই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ওদের সরে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা শব্দ করলে ওরা সরে যায়। একদিকে সাপ ইঁদুর খায়। আর ইঁদুর খাওয়ার কারণে ফসল রক্ষার পথ সুগম হয়। আবার কিছু সাপ অন্য সাপ খেয়ে পরিবেশ ঠিক রাখে। বর্তমানে দেশের কয়েকটি জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে সাপের চাষ হচ্ছে বিধায় সেখানে অনেক যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, সাপের বিষ অমূল্য সম্পদ। মাত্র এক আউন্স সাপের বিষের দাম কোটি টাকারও ওপরে। আর সাপের চামড়া দিয়ে তৈরি হয় নানারকম মূল্যবান শৌখিন জিনিসপত্র। অথচ এ প্রাণীকে নির্মমভাবে হত্যা করার প্রবণতা মানব মনের মধ্যে গেড়ে বসেছে; কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- একটিবারের জন্যও ভাবা হয় না যে সৃষ্টিকর্তার অনুপম সৃষ্টি এ প্রাণীটি। আমাদের জন্য কতই না উপকারী? এ ক্ষেত্রে একটি কথা না বললেই নয়, বিষধর সাপের সংখ্যা খুবই নগণ্য বিধায় এদের এড়িয়ে চলা তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বর্তমানে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ তৈরিতে সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া সাপের বিষে নানা রকম জটিল রোগের প্রতিষেধক তৈরি হয়। সত্যিকথা বলতে কি, প্রতি বছর ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ এবং মানুষের জন্য বিপজ্জনক বহুবিদ প্রাণী জীবন্ত খেয়ে সাপ অভূর্তপূব উপকার করে থাকে। এ ছাড়া দূর প্রাচ্যের দেশগুলোয় জীবন্ত সাপ রপ্তানি করা হয়। উল্লেখ্য, অধিকাংশ সাপের মাংসের রং সাদা এবং কোলেস্টরল মুক্ত বিধায় মনুষ্য স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী?

সাধারণত সাপ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে আঘাত না পেলে কামড়ায় না। তাই আমাদের বিষয়টি খেয়াল রেখে চলতে হবে। দুঃখের বিষয় হলো- রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে এতটাই মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে যে সাপের দেখা পেলে আর কথা নয় মারো, মেরে শেষ করে দাও। কিন্তু একটি খবর আমরা খুব কম মানুষই রাখি। এই সারা বিশ্বে বিষধর সাপের সংখ্যা নেহাত অপ্রতুল, যা গণনার মধ্যে নয়। মজার ব্যাপার হলো, সাপের বিষ দিয়েই সাপে কাটা রোগী নিরাময় করা হয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, সাপের বিষ সংগ্রহ করে ঘোড়ার গায়ে পুশ করা হয়। এতে ঘোড়া কিছুটা সময় অসুস্থ হলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। আর ওই বিষ ঘোড়ার শরীরে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে। আর এই অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করে অ্যান্টিভেনম তৈরিপূর্বক সাপে কামড়ানোর রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত


মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে বাংলাদেশ মর্মাহত

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে এক ঐতিহাসিক আত্মার সম্পর্ক। ভারতের সঙ্গে রয়েছে আমাদের ইতিহাসের, ভাষার, সংস্কৃতির, মন-মানসিকতার গভীর সমন্বয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে বর্তমান পর্যন্ত ৫৪ বছরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। বাংলাদেশ-ভারতের গৌরবময় সম্পর্কের গভীরতা অপরিমেয়। এই দুই দেশের সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রথা ও জীবনধারা হাজার বছর ধরে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দুই দেশের এ সম্পর্কের বীজ বপন হয়েছিল আজ থেকে ৫৪ বছর পূর্বে যখন পূর্ব পাকিস্তান নামক বাংলাদেশের আকাশে কালো মেঘ জমেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার এবং শোষণের ফলে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতই ছিল বাংলাদেশের একমাত্র ও নির্ভরযোগ্য মিত্রদেশ। সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি লোক সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। দেশটি দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশের আশ্রয়প্রার্থী ওই বিপুলসংখ্যক লোকের আশ্রয় ও আহারের ব্যবস্থা করেছে। তাছাড়া সারা বিশ্বকে মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের দুরবস্থা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা জানিয়েছে। এভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশও তার অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সঙ্গে সব সময় একটা সহযোগিতার সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে।

বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতের স্বার্থে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশও বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ ভারতের ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্ব অন্য রাজ্যগুলোর ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহনের জন্য চারটি রুটের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ। এ চার রুট হলো- চট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলাবন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর এবং মোংলাবন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর। ২০২১-২২ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ভারত এখন এশিয়ায় বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানির বাজার। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক, বিনিয়োগ, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন, বন্দর ব্যবহার, সীমান্ত হাট ইত্যাদির একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি হয়েছে। এসব খাত ব্যাপক অর্থনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করছে। এ ধরনের সহযোগিতা উভয়পক্ষের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন, যা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি রোল মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে। দুই দেশের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করায় দুই দেশ এখন যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে অতীতের তুলনায় তার পরিধি বিস্ময়করভাবে বিস্তৃত। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ এবং ইতোমধ্যে ভারত বাংলাদেশে ঘাটতি পূরণে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দরে জাহাজ নোঙরের সুবিধা দিচ্ছে। এ ছাড়া জ্বালানি, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে অনুমান করা যায় যে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনাময় এ সম্পর্কের অবমাননা হয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিস্তা পানি বণ্টন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উগ্র বক্তব্যে বাংলাদেশ মর্মাহত ও বাকরুদ্ধ। রাজ্য সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো আলোচনা করা উচিত হয়নি বলে উগ্র মন্তব্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরকালে শনিবার গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়ে আশ্বাস দেন নরেন্দ্র মোদি। তিস্তা ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য কারিগরি দল পাঠানোর কথাও বলা হয়। তবে এ নিয়ে আপত্তি তুলেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা ও ফারাক্কার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো রকম চুক্তিতে নিজের তীব্র আপত্তি রয়েছে জানিয়ে মমতা বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ নিয়ে কোনো আপস করব না।’ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গত ২৪ জুন চিঠি লিখে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি ভাগাভাগি করা সম্ভব নয়। কারণ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের মানুষের সেচ ও খাওয়ার জন্য এ পানির প্রয়োজন হয়। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে ১৯৮৩ সালে একটি অস্থায়ী চুক্তি হয়। আর ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করে দুই দেশ, যেখানে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ও ভারতের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ পানি পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থহানির যুক্তি দেখিয়ে এ চুক্তির বিরোধিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী পানির ওপর রাজ্যের অধিকার যেহেতু স্বীকৃত, তাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি উপেক্ষা করে তিস্তা চুক্তি রূপায়ণ কার্যত কেন্দ্রের পক্ষে অসম্ভব। এমতাবস্থায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা যা বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ উগ্র বক্তব্যের ফলে তিস্তা পানি বণ্টনে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাতে বাংলাদেশ অপূরণীয় ক্ষতির আরও বেশি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ বক্তব্যে বাংলাদেশ মর্মাহত।

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী, যা বাংলাদেশ এবং ভারত দুটি দেশেরই অংশ। এটি ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। পরে তা পদ্মা ও মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। তিস্তার অববাহিকা আনুমানিক ১২ হাজার ১৫৯ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। এ নদীটি বাংলাদেশ ও ভারতের তিন কোটির বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এর মধ্যে দুই কোটির বেশি মানুষ বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে তিস্তার অববাহিকায় বসবাস করে। ৪০ লাখ মানুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সিকিমের অববাহিকায় বসবাস করে। অর্থাৎ তিস্তার ওপর নির্ভরশীল ৭০ ভাগ মানুষ বাংলাদেশে তিস্তার অববাহিকায় বসবাস করে।

তিস্তা নদী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধান চাষের জন্য পানির প্রাথমিক উৎস এবং মোট ফসলি জমির প্রায় ১৪ শতাংশ সেচ প্রদান করে। তিস্তা ব্যারাজ প্রজেক্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প। এটাও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। এ প্রকল্পটির অন্তর্ভুক্ত উত্তরবঙ্গের ছয়টি জেলা যথা- নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট এবং এর ‘কমান্ড এরিয়া’ (আওতাভুক্ত এলাকা) ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর বিস্তৃত। তিস্তার সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিস্তা নদীতে ভারতের উজানে পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিমে বাঁধ, ব্যারেজ, জলবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ অবকাঠামোগুলো তিস্তার উজানে পানির চাহিদা পূরণ করছে। কিন্তু তা ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীতে পানির প্রাপ্যতা দারুণভাবে হ্রাস করেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণের আগে বাংলাদেশের ডালিয়া সীমান্তে তিস্তার গড় বার্ষিক পানির প্রবাহ ছিল ৬ হাজার ৭১০ কিউসেক (ঘনফুট প্রতি সেকেন্ড)। ১৯৯৫ সালে গজলডোবা ব্যারেজ চালু হওয়ার পর তা কমে ২ হাজার কিউসেকে দাঁড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন প্রবাহ ১ হাজার ৫০০ কিউসেক থেকে ২০০-৩০০ কিউসেকে নেমে আসে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ভূপৃষ্ঠের পানির প্রবাহ হ্রাস এবং সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে তিস্তা অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত এক দশকে প্রায় ১০ মিটার নিচে নেমে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় তা সেচের ক্ষেত্রে এবং কৃষি ফলনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসলগুলোর একটি বোরো ধান উৎপাদনে এর প্রভাব ব্যাপক। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, তিস্তার পানির ঘাটতির কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে। এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশের সমান যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়।

সুতরাং, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী এমন বক্তব্য খুবই দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে তিস্তার পানি ব্যবহার করার অধিকার ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের কোনো অংশে কম নয় বরং বেশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে তিস্তা ব্যবহারে বাংলাদেশের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের বিধান লঙ্ঘিত হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত ঐতিহাসিক সেই সম্পর্কে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের নিকট বাংলাদেশের আবদারের যে জায়গাটা ছিল সেটা নষ্ট হয়েছে। মমতার বাংলাদেশ বিরোধী তথা তিস্তা পানি বণ্টনবিরোধী এমন বক্তব্য কোনোভাবেই উচিত হয়নি। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন প্রয়োজনে বাংলাদেশ যেমন নিঃস্বার্থভাবে সব সময় এগিয়ে এসেছেন ঠিক তেমনি ভারতকেও বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে সব সময় এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক: উপাচার্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়


একটি গ্রামীণ পাঠাগার, একটি বাতিঘর

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন

রবীন্দ্রনাথ তার লাইব্রেরি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেউ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই পাঠাগারের তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে। মানবাত্মার অমর আলোক কাল অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, একটি পাঠাগার আমাদের সামাজিক জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পাঠাগারের মূল সম্পদ হলো বই। সভ্যতার চাকা এগিয়ে নিতে বইয়ের ভূমিকা অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বই চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। বইয়ের সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘সত্যিকার বৈদগ্ধ ও চিৎ প্রকর্ষের অধিকারী হতে হলে লাইব্রেরির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করা অবশ্যই প্রয়োজন।’ ‘গ্রন্থাগার’ বা প্রকৃত অর্থে ‘পাঠাগার’ হলো বই, পুস্তিকা ও অন্যান্য তথ্য সামগ্রীর একটি সংগ্রহশালা; যেখানে পাঠকের প্রবেশাধিকার থাকে এবং পাঠক যেখানে পাঠ, গবেষণা কিংবা তথ্যানুসন্ধান করতে পারে। ‘গ্রন্থাগার’ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে গ্রন্থ+আগার এবং ‘পাঠাগার’ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে পাঠ+আগার পাওয়া যায়। অর্থাৎ গ্রন্থসজ্জিত পাঠ করার আগার বা স্থান হলো গ্রন্থাগার বা পাঠাগার। গ্রন্থাগারের মূল লক্ষ্য থাকে তথ্যসংশ্লিষ্ট উপাদান সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সংগঠন, সমন্বয় এবং পাঠকের জন্য তা উন্মুক্ত করা।

একটি জাতির বিকাশ ও উন্নতির মানদণ্ড হলো পাঠাগার। এই পাঠাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সংহতি, যা দেশ গড়া কিংবা রক্ষার কাজে এক অমূল্য অবদান। চিন্তাশীল মানুষের কাছে গ্রন্থাগারের উপযোগিতা অনেক বেশি। গণতন্ত্রের সাফল্যে গ্রন্থাগারের ভূমিকা গণমাধ্যমের চেয়ে কম নয়। আধুনিক বিশ্বে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। গ্রন্থাগার সবার জন্য উন্মুক্ত। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নেই এখানে, নেই হানাহানি, কলহ। কাজেই জাতির মর্যাদাবোধের উন্নয়নে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য পাঠাগার হলো একটি সহায়ক শক্তি। আমরা মরণপণ লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি; কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের পাটাতনকে মজবুত করে এমন সব কাজে আমাদের মনোযোগ নেই বললেই চলে। এর ফলে দেখা দেয় বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যা। পাঠাগার একটি স্বাধীন দেশের পাটাতনকে মজবুত করার অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার।

যুগে যুগে সমাজের সুধী-সজ্জন ব্যক্তির দ্বারাই গড়ে উঠেছে পাঠাগার। মনকে সতেজ ও প্রসারিত করে জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য যা অবশ্যই অপরিহার্য। সেই তাগিদ থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মানসে ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার নিজগালুয়া গ্রামে শিক্ষানুরাগী প্রয়াত মাস্টার জহির উদ্দিন মিয়ার শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্মরণে ‘মাস্টার জহির উদ্দিন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার’ নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়। পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন প্রয়াত জহির উদ্দিন মিয়ার ছেলে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনোয়ার হোসেন। পাঠাগারটি গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, ঢাকার নিবন্ধনভুক্ত এবং সপ্তাহে পাঁচ দিন উন্মুক্ত থাকে। গ্রামের সব বয়সের নারী ও পুরুষ পাঠকের কথা বিবেচনা করে পৃথক পৃথক পাঠ কর্নারের ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের জন্য রয়েছে শিশু কর্নার। অতীত ইতিহাস থেকে শুরু করে সমসাময়িক সব বিষয়Ñমুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা, সাহিত্য, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, কৃষিনির্ভর, পাঠ্যবই, বিজ্ঞানবিষয়ক আইটি, আইন ও বিধি, সাধারণ জ্ঞান, জ্ঞানকোষসহ রয়েছে তিন সহস্রাধিক বইয়ের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের বহু আগে মিসরে এবং প্রাচীন গ্রিসেও পাঠাগারের অস্তিত্ব ছিল। ভারতে প্রাচীনকালে পণ্ডিতদের ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। আধুনিককালে বিজ্ঞানের সহায়তায় উন্নত পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারত উপমহাদেশে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা এবং গ্রন্থাগার চর্চার ইতিহাস বহু পুরোনো। মোগল আমলে এবং তারও আগে প্রাসাদকেন্দ্রিক ছিল গ্রন্থাগার। ব্রিটিশ শাসনামলে অভিজাত শ্রেণির অনেকের বাড়িতে ছিল পারিবারিক গ্রন্থাগার। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে স্থানে স্থানে গণগ্রন্থাগার স্থাপনে বিভিন্ন মহলের উদ্যোগী ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। ৫০ থেকে ৬০ এমনকি ৭০ দশকেও আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজে ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য গ্রন্থাগার ছিল।

মাস্টার জহির উদ্দিন মিয়া গ্রামের কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা নিয়ে ১৯২৮ সালে নিজগালুয়া গ্রামে একটি পাঠশালা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে জি কে হাই স্কুল নামে নিজগালুয়া গ্রাম তথা রাজাপুর উপজেলায় শিক্ষার গুণগত মান বিচারে অন্যতম স্কুল হিসেবে দাবি রাখে। শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নে মাস্টার জহির উদ্দিন মিয়াসহ সংশ্লিষ্টদের অবদানকে স্মরণে রাখার মানসেই পাঠাগারটি গড়ে তোলা হয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পাঠাগারটিতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে আঞ্চলিক ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, নারী, পুরুষ ও শিশুর জন্য পৃথক পৃথক পাঠ কর্নার, ইন্টারনেট সুবিধা সংবলিত কম্পিউটার যেখানে জরুরি প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস প্রিন্ট করা, অনলাইনে আবেদন করা কিংবা ই-মেইল যোগাযোগ করার সুযোগ রয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাঠাগারের পাশাপাশি এখানে ইসলামিক ফাইন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দৈনিক ত্রিশ জনের মতো শিশু শিক্ষার্থী উক্ত শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া এখানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে এম এম (মনোয়ার-মমতাজ) যুব কল্যাণ সংঘ নামে সরকারি নিবন্ধকৃত আরেকটি প্রতিষ্ঠান পাঠাগারের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। সেখানে দুটি সেলাই মেশিন রাখা আছে; যেখানে গ্রামের মা-বোনদের স্বাবলম্বী করার মানসে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার সহায়তায় সেলাই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। সফলভাবে প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে কৃতকার্য প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ সনদপত্র বিতরণ করা হয়েছে।

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় ক্রীড়াচর্চা ও ক্রীড়ানুশীলনের বিকল্প নেই। লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে এবং তারা মাদকাসক্তিসহ অন্যান্য সামাজিক অবক্ষয় থেকে দূরে থাকে। তাই সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে এম এম (মনোয়ার-মমতাজ) যুব কল্যাণ সংঘের উদ্যোগে ‘মাদকের বিরুদ্ধে ফুটবল’ প্রতিপাদ্যে উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফুটবল বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিভাবান খুদে খেলোয়াড় বাছাইয়ের লক্ষ্যে এম এম (মনোয়ার-মমতাজ) যুব কল্যাণ সংঘ হতে উপজেলাব্যাপী ফুটবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়েছে। প্রত্যয় ‘সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ তৈরি করা’।

মাস্টার জহির উদ্দিন মিয়া স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোগে ও আয়োজনে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে- সরকারি ও বেসরকারি দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানে বছরের শুরুতে পাঠাগার কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক ক্যালেন্ডার বিতরণ; শিক্ষার্থীদের বছরের শুরুতে পাঠাগার কর্তৃক প্রকাশিত বার্ষিক ক্যালেন্ডার ও ক্লাস রুটিন বিতরণ; মেধাবী ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বই ও শিক্ষা সহায়ক উপকরণ বিতরণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ; উপজেলা পর্যায়ে ফুটবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতার আয়োজন; পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা সহায়ক উপকরণ বিতরণ; জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসসহ সকল জাতীয় দিবস উদযাপনে অংশগ্রহণ; ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন; ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন; ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দোয়ার আয়োজন; ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন; মাহে রমজান উপলক্ষে আন্তঃউপজেলা ক্বিরাত ও হামদ/না’ত প্রতিযোগিতার আয়োজন; মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে রচনা প্রতিযোগিতা এবং টি-২০ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আয়োজন; মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরীয় প্রদান; গ্রাম পুলিশদের বর্ষায় ছাতা বিতরণ; অটিস্টিক শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়ক উপকরণ বিতরণ; গ্রামের অসচ্ছল পরিবারে ঈদবস্ত্র ও শীতবস্ত্র বিতরণ; শারদীয় দুর্গোৎসবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শারদ শুভেচ্ছাসামগ্রী বিতরণ; করোনাকালে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা উপকরণ বিতরণ, অসচ্ছল শিক্ষার্থী ও পরিবারের মধ্যে খাদ্য সহায়তা প্রদান; বাজারে বিনামূল্যে সবজির ভ্রাম্যমাণ দোকান পরিচালনা; উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জীবাণুনাশক চেম্বার, আইভি স্যালাইন এবং খাবার স্যালাইন সহায়তা প্রদান; এলাকার দরিদ্র, অসহায় ও অসচ্ছল পরিবারকে আর্থিক, চিকিৎসা ও আইনী সহায়তা/সহযোগিতা প্রদান এবং তাদের স্বাবলম্বী করার প্রয়াসে জীবন-জীবিকার জন্য/উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার উপযোগী/সহায়ক উপকরণ প্রদান।

পাঠাগারের সাফল্যের মধ্যে-জেলা প্রশাসন ও জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার, ঝালকাঠি কর্তৃক জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস-২০১৯, জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস-২০২০ এবং জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস-২০২৪ উপলক্ষে ‘মাস্টার জহির উদ্দিন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার’ তিনবার ঝালকাঠি জেলার ‘সেরা বেসরকারি পাঠাগার’ হিসেবে নির্বাচিত; মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারা দেশের এক হাজার সরকারি ও বেসরকারি গ্রন্থাগারের ন্যায় মাস্টার জহির উদ্দিন মিয়া স্মৃতি পাঠাগারে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ স্থাপন; উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার সহায়তায় দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রশিক্ষক দিয়ে গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করার মানসে হাতে-কলমে ৩২ (বত্রিশ) জন নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ শেষে উত্তীর্ণ ২০ (বিশ) জন নারীকে সনদপত্র বিতরণ করা হয়; জেলা প্রশাসন, ঝালকাঠি কর্তৃক আয়োজিত জীবনানন্দ দাশ উৎসব-২০১৯-এ পাঠাগারের সেরা স্টলের স্বীকৃতি লাভ।

কেবল সফলতা অর্জনই নয়, ‘মাস্টার জহির উদ্দিন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার’-এর মূল উদ্দেশ্য গ্রামের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে মিতালী করে তাদের শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আত্মিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে সার্বিক কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনে নিরন্তর প্রচেষ্টারত থাকা।

জাতীয় জীবনে পাঠাগারের গুরুত্ব অনেক। সেই নিরিখে বলা যায়, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্য প্রয়োজন, তেমনি মানুষের ক্লান্ত ও বুভুক্ষু মনকে প্রফুল্ল করতে পারে একমাত্র বই, আর পাঠাগার হলো সেই বইয়ের আধার। পাঠাগার হলো মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর সেই সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে তার প্রকৃত উপকার যাতে প্রতিটি মানুষ ভোগ করতে পারে, সে কারণে দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাঠাগার গড়ে তোলা প্রয়োজন; যা জাতির জন্য হবে একেকটি আলোকবর্তিকা।

লেখক: পুলিশ সুপার নৌ পুলিশ, সিলেট অঞ্চল


সুশাসন সুশাসনের স্বার্থেই হওয়ার বিকল্প নেই

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদূল মজিদ

উন্নয়নের সম্মোহিত সমকালের বিগত ১৫ বছরের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এটি পরিষ্কার, সুশাসন অর্থাৎ জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ছাড়া স্থিতিশীল ও উন্নয়ন বলতে যা বোঝায় অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মানবিক উন্নয়ন সম্ভব হয় না। নেতিবাচকরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, বিগত বছরগুলোতে যে উন্নয়ন তা ধোপে টিকবে কি না; যখন দেশে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুট, কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, উন্নয়নের আড়ালে লুণ্ঠিত হয়েছে মানবাধিকার, নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে কয়েক গুণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মান শূন্যের কোটায় ঠেকেছে। সুতরাং জনগণের কাছে উন্নয়নের জিকির কতটা টিকবে তা বলা মুশকিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যে যদি সুষ্ঠু, অবাধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয়, তবে জনগণ তাদের সাংবিধানিক অধিকার অর্থাৎ ভোটের অধিকার ফিরে পাবে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে মহাজোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, যারা জিতবে তারা সরকার গঠন করবে এবং সংসদ চলবে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল নিয়ে। এতে সংসদ কার্যকর হবে এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে। একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক সরকার গঠিত হবে, যা জনগণ ও দেশের জন্য একান্ত কাম্য। দেশ সংকট থেকে মুক্তি পাবে এবং বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। এ আশঙ্কাও প্রবল হয়ে উঠছিল যে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়, তবে যেসব চিত্র অনুমান করা হয় সেগুলো অতি জটিল এবং দেশের জন্য কোনো রকম সুবাতাস বয়ে আনবে না। হয়তো বাংলাদেশের কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর জন্য নিয়ে আসবে অতিমাত্রায় সুখবর। চিত্রগুলোর বিবরণ নিম্নে আলোচনা করা হলো-

প্রথমত, সরকারি দলের নির্যাতন, সহিংসতাসহ সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে যদি ঐক্যজোটের জেতার সম্ভাবনা দেখা দিত তবে নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত না হওয়ার যথেষ্ট সংশয় তৈরি হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশকে অনির্দিষ্টকালের জন্য চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। দ্বিতীয়ত, ২০০৯ সালের পর থেকে গণতন্ত্রায়ণের পশ্চাৎধাবন আরও গভীর ও দ্রুত হয়ে বাংলাদেশ একটি পূর্ণ কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে। এমনকি দেশে স্বৈরতন্ত্র অন্যরূপে আবির্ভূত হওয়ার শঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যেত না। তৃতীয়ত, নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা নির্বাচন-পরবর্তীতে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি দেশকে এমন অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে, যা বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ অস্থিতিশীলতা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। চতুর্থত, রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে বেকার তরুণ-তরুণীদের সহিংস উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে। পঞ্চমত, অন্য মতের দমন-পীড়ন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অন্যান্য মানবাধিকার হরণ আরও গভীর হবে এবং নিপীড়নের শিকার জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তরুণরা বিচারের আশায় প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এবং অন্য বিকল্প খোঁজার জন্য ব্যাপকভাবে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।

এটা দিন দিন স্পষ্ট হতে চলেছে যে উদীয়মান আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য চীন ও ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতা আরও তীক্ষ্ণ ও দ্বন্দ্বমূলক হয়ে উঠছে; যাতে অন্যান্য বৃহৎ শক্তিও জড়িয়ে পড়বে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ঘিরে। বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশের মতো একটি নাজুক ও বিভক্ত জাতি হিসেবে নিজেদের স্বাধীনতা পুরোপুরি ধরে রাখতে বেশ চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন হতে পারে। সেটি অবশ্যই একটি চিন্তার বিষয়। এ প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশা ও গণআকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল যে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচনের দ্বারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে উঠুক, যাতে বিরাজমান বিভাজনের অবসান ঘটে এবং দেশ শান্তির পথে এগিয়ে যায়।

উন্নয়নগতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অধিক পরিমাণ বিনিয়োগের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। এ জন্য অভ্যন্তরীণ বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণেরও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে মরাকটাল চলছেই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সাফল্যে আস্থা ফিরে আসা বা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকিং শিল্পই মূলত এককভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের অর্থের জোগানদার। সুতরাং ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সুশাসন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং গ্রাহকের আস্থা অক্ষুণ্ন রাখা দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিছু কিছু ব্যাংকের ঋণখেলাপি সমস্যা নীতিনির্ধারক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য অংশীদারি পক্ষের জন্য উদ্বেগের কারণ। পাশাপাশি বেশকিছু ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। এ সমস্যা সমাধানে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। সার্বিকভাবে সুশাসনের অভাব কিছু কিছু ব্যাংকের জন্য উদ্বেগজনক, আবার পরিচালনা পর্ষদের সহযোগিতায় ও ব্যাংক নেতৃত্বের দক্ষতায় ব্যাংকের দৃশ্যমান ও ইতিবাচক পরিবর্তনের নিদর্শনও বাংলাদেশে আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, দুর্বলতার দিকগুলো তথ্য-উপাত্তের সহজলভ্যতার কারণে যেভাবে প্রচারিত হয়েছে, সফলতার দিকগুলো সেভাবে প্রচারিত হয়নি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত কয়েক বছরে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের ঝুঁকি নিরসন সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ব্যাংকিং একটি স্পর্শকাতর খাত। ব্যাংকিং খাত সম্পর্কিত যেকোনো মন্তব্য এবং বক্তব্য এমনকি খবর গণমাধ্যমের সুবাদে সাধারণ গ্রাহককে প্রভাবিত করতে পারে। ব্যাংকিং খাত সম্পর্কিত যেকোনো আলোচনা বা পর্যালোচনা এ খাতের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার পাশাপাশি সফলতা ও সক্ষমতার দিকগুলো সমানভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকলেও ব্যাংকিং খাত সম্পর্কিত যেকোনো পর্যালোচনা একদিকে যেমন ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাগুলোকে তুলে এনে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে, তেমনি অন্যদিকে সফল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহ জোগাবে এটাই কাম্য। অর্থনৈতিক কাঠামোগত রূপান্তর ও ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়নে ঘনিষ্ঠ এবং সতর্কতামূলক যোগাযোগ গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়াটা সমীচীন হবে।

ভুলে গেলে চলবে না বর্তমানে বাংলাদেশের সনাতন সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ এক বিশেষ সময় পার করছে। ব্যাপক পরিবর্তনের পেছনে লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার অপব্যবহার অপপ্রয়োগ অপচেষ্টার মাত্রাগত ওঠানামা যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় তেমনি যাবতীয় উন্নয়ন অভিযাত্রাকে টেকসইকরণে মনোযোগে মনোমালিন্যের দৈন্য ও দুর্দশার সুরও শোনা যায়। লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া কোনো উন্নয়ন যেমন সম্ভব নয় তেমনি সেই উন্নয়নকে টেকসইকরণের ভাবনা সংযুক্ত না থাকলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। লাগসই প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াসকে অর্থবহ করে তোলে। কৃষি জমিতে ধান ফল ফসল উৎপাদনের চেয়ে সেখানে লোনা পানি তুলে পরিবেশ বিপন্ন করে মাছের চাষ করার লাগসই প্রযুক্তি আপাত আর্থিক লাভ ঘটায় বটে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নের জন্য তা কতটা কার্যকর বা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত প্রয়াস তা পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা উঠে আসে। লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার তখনই তাৎপর্যবহ হবে যখন দেখা যাবে ন্যূনতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া বর্জন ও অর্জনের মধ্যে দূরত্ব দৃশ্যগোচর হয়ে দেশজ সম্পদ ও সেবা উৎপাদন নিরাপত্তার সঙ্গে নির্ভরতার সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে সময়ের কষ্টিপাথরে যা যাচাইযোগ্য হয়ে স্থায়িত্ব লাভ করে তাই-ই টেকসই উন্নয়ন।

শিক্ষা মানুষকে চক্ষুষ্মান করে, শিক্ষায় মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শক্তি সুপ্ত অবস্থা থেকে জেগে ওঠে। শিক্ষা মানুষের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করে, তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, সবাক, সকর্ম করে তোলে। মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার যেমন বিকল্প নেই, জাতীয় জীবনমানের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষায় বিনিয়োগেরও তাই কোনো বিকল্প নেই। তবে কেমন বিনিয়োগ, কতটা বিনিয়োগ, বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ও উদযাপনের উপায় কি এ বিষয়গুলো পর্যালোচনায় আনা বা আসার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।

একটি বৃক্ষকে সত্যই সবল ও সুস্থ হয়ে বড় বা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে হলে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকৃত পরিচর্যা প্রয়োজন। এ সময়টা দেখভালের প্রয়োজনীয়তা এ জন্য জরুরি ও আবশ্যক যে এ পর্যায়ে কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত, জরাগ্রস্ত, দুর্দশাগ্রস্ত হলে পরবর্তী পর্যায় তথা অপরাপর অংশে সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠবে এবং একসময় গোটা গাছটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইদানীং পরীক্ষাব্যবস্থাকে মূল্যায়নমুখী দেখার পরিবর্তে পাস বা গ্রেডনির্ভর ভাবা হচ্ছে; আর পাসের হার বাড়ায় বিশেষ পরিতৃপ্তিবোধ দেখা যায়। মশহুর ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের অ্যানশিয়েন্ট মেরিনার যেমন সমুদ্রে চারদিকে থই থই করা অপানযোগ্য পানি দেখে তার তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারেননি। তেমনি লাখো কোটি শিক্ষিতের মধ্যে উপযুক্ত চাকরি প্রার্থী মিলছে না। বাইরের শিক্ষিত লোক এসে চাকরি বাজার মাত করছে বেকারের ভারে ন্যুব্জ এই অর্থনীতিতে। উচ্চতর শিক্ষায়তনে ভর্তির দুয়ারে গিয়ে অপারগ অনেককেই ঠায় দাঁড়ানো দেখতে হচ্ছে।

লেখক:উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


ভিক্ষাবৃত্তি পরিহার আবশ্যক

আপডেটেড ২৯ জুন, ২০২৪ ১১:২৫
সৈয়দ শাকিল আহাদ

আদিযুগ থেকেই মানব সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি চালু ছিল তা কম-বেশি আমাদের দেশের সর্বত্রই বিস্তৃত। আমাদের এই উপমহাদেশে বিশেষ করে আমাদের এই অঞ্চলে তা দীর্ঘদিনের। তবে বর্তমান বাংলাদেশে অঞ্চভেদে তার ভিন্নতা রয়েছে।

বিশেষ করে রাস্তা-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে চলাচল করলে বোঝা যায় তা হোক শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্রই এর ব্যাপকতা লক্ষণীয়।

‘নবীর শিক্ষা করোনা ভিক্ষা মেহনত করো’ সবে। আমরা সেই শিক্ষার কথা ভুলে গিয়ে, সহজেই হাত পাতার মতো সহজ পদ্ধতিতে এই পেশার দিকে ধাবিত হই বেশি এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিক্ষুকসমাজ ও সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি বিভিন্ন এনজিওর সংগৃহীত তথ্যমতে এখন এক এলাকার ভিক্ষুক অন্য এলাকায় গিয়ে সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়তে হয় এবং মাঝেমধ্যে নিজেদের মারামারি ও সংগঠিত হচ্ছে। এখন দেশে প্রকৃত ভিক্ষুকের সংখ্যা কত তা বের করার উদ্দেশে সম্প্রতি সরকার সারা দেশের ভিক্ষুকদের ডেটাবেজ তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানিয়েছেন বর্তমান সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি।

তিনি বলেন, ‘সঠিক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রকৃত ভিক্ষুকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন করা হবে।’

রোববার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগমের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

দীপু মনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে জীবন-জীবিকার জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল এরূপ ঠিকানাবিহীন কত লোক বসবাস করে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। নদীভাঙন, অতি দারিদ্র্য, রোগব্যাধি, অশিক্ষা প্রভৃতি কারণে কিছু লোক ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হচ্ছেন, যাদের প্রকৃতপক্ষে সাহায্যের দরকার আছে।’ তার মতে ‘কিছু কিছু কর্মবিমুখ লোক সহজ আয়ের পথ হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নিয়েছেন। পাশাপাশি কিছু দুষ্টুচক্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অসহায় মানুষকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করাচ্ছেন।’

ইংরেজদের শোষণ, বঞ্চনা এবং নদীভাঙন, দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি, অশিক্ষা ইত্যাদি কারণে কেউ কেউ আবার ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। বর্তমান সময়ে কিছু মানুষের কর্মবিমুখতা এবং তার সঙ্গে একদল স্বার্থান্বেষী মহলের অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ভিক্ষাবৃত্তি নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক ব্যাধি। এটি স্বীকৃত কোনো পেশা নয়।

ভিক্ষার ক্ষেত্র ধর্মীয় ব্যাখ্যা হলো ধর্ম, যেমন- খ্রিষ্ট ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, সুফি ইসলাম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির অনুগামীদের জন্য একমাত্র জীবিকা হিসেবে ভিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলে, যাতে তারা জাগতিক মায়ায় আটকা না পড়ে আত্মিক উন্নতিসাধনের পথে অগ্রসর হতে পারে।

বৌদ্ধ ধর্মে, ভিখু ও ভিখুনীরা ঐতিহ্যগতভাবেই ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে, এমনকি একই কাজ করেছেন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ। এটা এ কারণে, এতে সাধারণ মানুষ ভিখুদের খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দেওয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় গুণাবলি অর্জন করতে পারে।

মূলত ভিক্ষা হচ্ছে কোনো রকম লেনদেনের চিন্তা ছাড়াই, অপরের অনুগ্রহে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা। বিভিন্ন জনসমাগমপূর্ণ স্থান, যেমন- শহুরে পার্ক, ব্যস্ত বাজার, বাস কিংবা ট্রেন স্টেশনে ভিক্ষুকদের দেখা যায়। অর্থ ছাড়াও ভিক্ষুকরা খাদ্য, পানীয়, সিগারেট কিংবা অন্যান্য কিছু চেয়ে থাকে।

বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণ ঘটেছে। ভিক্ষাবৃত্তির লজ্জা থেকে দেশকে মুক্ত করার সময় এসেছে।

দেশে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে মানুষকে নিবৃত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বর্তমান জনবান্ধব সরকার ভিক্ষাবৃত্তির মতো সামাজিক ব্যাধিকে চিরতরে নির্মূলের বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক।

বিষয়টি বিবেচনায় এনেই ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশের ৫৮টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের নিমিত্তে অর্থ প্রেরণ করা হয়।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ৫৮টি এবং পরবর্তীতে বাকি ৬টিসহ মোট ৬৪টি থেকে জেলা প্রশাসক ও উপপরিচালক, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের যৌথ স্বাক্ষরিত চাহিদাপত্রে ২,৫০,০০০ (দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার) জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য ৪৪৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটে ৩.০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। ৩৮টি জেলায় উক্ত অর্থ ভিক্ষুক পুনর্বাসনের নিমিত্তে জেলা প্রশাসক ও উপপরিচালকের যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত ব্যাংক হিসাবে প্রেরণ করা হয়।

ঢাকা শহরে ভিক্ষাবৃত্তি রোধের জন্য প্রাথমিকভাবে সরকার শহরের কিছু এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। এলাকাগুলো হচ্ছে- বিমানবন্দরে প্রবেশ পথের পূর্ব পাশের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশ এলাকা, হোটেল রেডিসনসংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলী রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল রূপসী বাংলাসংলগ্ন এলাকা, রবীন্দ্র সরণি এবং কূটনৈতিক জোনগুলো। ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকাগুলো ভিক্ষুকমুক্ত রাখার লক্ষ্যে নিয়মিত মাইকিং, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ এবং বিভিন্ন স্থানে নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাগস্ট্যান্ড মেরামত/নতুন স্থাপন করার কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে আটককৃত ভিক্ষুকদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার নিমিত্তে ৫টি আশ্রয়কেন্দ্রের অভ্যন্তরে ফাঁকা জায়গায় অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৬টি টিনশেড ডরমিটরি ভবন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। সম্প্রতি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ৩৭০০ জন ভিক্ষুকে আটক করা হয়। আটককৃতদের রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় ৭৫০ জনকে (ভিক্ষাবৃত্তি না করার শর্তে) মুক্তি দেওয়া হয়।

অবশিষ্ট ২১৩০ জনকে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের নিমিত্ত আশ্রয়কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়েছে।

ভিক্ষুকরা ভীষণ কৌশলী, বিশেষ করে ঢাকার রাস্তায় ও ফুটওভার বিজে এত বেশি স্পর্শকাতরভাবে এরা নানারকম অজুহাত দেখিয়ে, কানা, লেংড়া, লুলা, সেজে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে থাকে যা সত্যিই চাঞ্চল্যকর।

বিশেষভাবে সরকারি উদ্যোগে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের কাজটি পদ্ধতিগতভাবে করার জন্য ইতোমধ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি।

ইসলামেও এই ভিক্ষাবৃত্তি পেশাকে নিরুৎসাহিত করে পবিত্র হাদিসে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘কষ্ট করে পিঠে বোঝা বহন করে জীবনযাপন করা ভিক্ষাবৃত্তি থেকে অনেক উত্তম।’ (বুখারি: ১৪৭১)। অন্য হাদিসে রসুল (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ওপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম।’ (বুখারি: ১৪২৭)।

বৈধ ও পবিত্র উপায়ে অর্থোপার্জন জরুরি। ইসলাম এই বিষয়েই উৎসাহ দেয়। কারণ, ইবাদতের সঙ্গে আর্থিক সামর্থ্য জড়িত। ইবাদত ও দোয়া কবুল হওয়ার জন্য হালাল জীবিকা এবং বৈধ উপার্জন হলো পূর্বশর্ত।

মহান আল্লাহতাআলা সবার রিজিকদাতা। তিনি মানুষের জন্য ব্যবস্থা করেছেন ‘রিজকান কারিমা’ (সম্মানজনক জীবিকা) এবং এর অর্জন কৌশল হতে হবে ‘হালালান তাইয়্যেবা’ বা বৈধ ও পবিত্র। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৬৮)

আমাদের আশপাশে যারাই এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত এদের যথার্থ কাউন্সিলিং-এর মাধ্যমে ও সহানুভূতিশীল হৃদয় নিয়ে ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক


শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত সরকারের অন্যতম সাহসিকতা

আপডেটেড ২৯ জুন, ২০২৪ ১১:২৫
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে সর্বমহলে এক ধরনের ব্রিবতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি অনেকটা অপেন সিক্রেটের মতো। কারণ প্রশাসন কিংবা প্রভাববিস্তারকারী গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের কারও কারও সীমাহীন দুর্নীতিই প্রমাণ করে নৈতিকভাবে শক্ত না হলে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে তোলা কঠিন কোনা বিষয় নয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার উচ্চারণ করে বলেছিলেন, তিনি ছাড়া আর কাউকেই দুর্নীতি করা না করার প্রশ্নে বিশ্বাস করা যায় না। কথাটি পুরোপুরি ঠিক এমনটি না হলেও অনেকটা এমনই। এমনকি তিনি এ জন্য তার পরিবারের ডেফিনিশন দিয়েছিলেন অর্থাৎ কে কে তার পরিবারের সদস্য। আমরা বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা লাগামহীন দুর্নীতি করেছেন, বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। এখন গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ইস্যু সামনে এলে তার গোড়া খুঁজতে গেলেই কোনো না কোনো দুর্নীতির সূত্র পাওয়া যায়। এসব পরিস্থিতিতেই সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে গোপনে তদন্ত কমিটি গঠন করে এই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য অবশ্য সরকার ইতোমধ্যেই নানা ধরনের অভিযান শুরু করেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ, এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতি সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার প্রশাসনে কারা দুর্নীতি করছে এবং কীভাবে দুর্নীতি করছে সে ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ এবং নির্মোহ তদন্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হবে। বিশেষ করে কারা অবৈধভাবে সম্পদ বানিয়েছে, কারা বেপরোয়াভাবে দুর্নীতি করছে সে ব্যাপারে সব তথ্য উদ্ধার করা হবে এবং পুরো প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনাই মূল উদ্দেশ্য। সাধারণত ধারণা করা যায় যে প্রশাসনের চাকরিতে যেমন ক্ষমতা কিংবা দাপট রয়েছে তেমনি অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে। ফলে চাকরিপ্রার্থীরা শিক্ষা ক্যাডারকে পছন্দক্রমের শেষে দেয়। অন্যদিকে প্রশাসন কিংবা প্রভাবশালী ক্যাডার বিশেষত পুলিশ, ফরেন এবং কাস্টমসকে অগ্রাধিকার দেয়।

আমরা জানি অনেক আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। এমনকি ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিবছর সম্পদের বিবরণ দাখিল করা সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। সরকার এখন এটি কঠোরভাবে মানার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তা ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের অতীত রেকর্ড, তাদের সম্পদ এবং আয়-ব্যয়ের উৎস সম্পর্কে তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে। বিভিন্ন দায়িত্বশীল সংস্থাকে এ ব্যাপারে কঠোর নিদের্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রশাসনে যদি সততা এবং ন্যায়-নিষ্ঠা না থাকে তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হবে, সরকারের ইমেজ নষ্ট হবে। এখন অনেকেই মনে করছেন সরকারের ছত্রছায়ায় থেকেই এবার বেপরোয়া, দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠেছেন। তবে বিভিন্ন মহল মনে করছেন যে, এরা আসলে ছত্রছায়ায় এসেছেন দুর্নীতি করার জন্যই। হঠাৎ বনে যাওয়া এই সব অতিভক্তদের কারণেই সরকারের বদনাম হচ্ছে। এরাই সরকারের কাছে মানুষ সেজে নানা রকম অনিয়ম এবং দুর্নীতি করছে। আর এ কারণেই প্রশাসনে নতুন করে শুরু হচ্ছে শুদ্ধি অভিযান।

দীর্ঘদিন থেকেই দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ব্যাপক আলোচনা চলছে। টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসায় জনগণের চাহিদাও বেড়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে এবং পরে জনগণের প্রত্যাশার খবরটি অধিকভাবে সামনে আসে। সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত প্রায় সাড়ে ১৫ বছরে বিভিন্ন সময়ে সরকার নানা ধরনের শুদ্ধি অভিযানের বিষয় আমরা দেখেছি। দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক সেটি বড় কথা নয়, বরং সরকারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগ প্রধান বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের ফলে তটস্থ থাকে সরকার এবং দলের সব স্তর। সরকার এবং দলের হাইকমান্ড থেকে বারবার বলা হয়েছে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, ইয়াবাখোর ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে দলের কেউ জড়িত থাকলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে এর আগে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে পরিবর্তন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের নেতাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি যথেষ্ট চাঞ্চল্যতা পেয়েছিল। ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ থেকে শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি একসময় আলোড়ন তৈরি করেছিল। এর পরও দলের এবং দলের বাইরের অনেকের বিরুদ্ধেই সরকারের পদক্ষেপ আমরা লক্ষ করেছি। মূলত সরকারের সদিচ্ছার ফলেই এমন অভিযান আলোর মুখ দেখছে। এ ধরনের অভিযানকে দেশবাসী খুব ভালোভাবে নিয়ে থাকে।

প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের না, তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। সরকার নানা রকম সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তবতার কারেণ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান করতে পারছে না এ কথা সত্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন এমন কথা কেউ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে পারবেন না। দুর্নীতিবাজদের কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে প্রচার চালানোর এক নোংরা খেলা ইদানীং প্রকট হয়েছে। এটি পরিকল্পিত মিথ্যাচার। এর উদ্দেশ্যে একটি জনগণের আস্থার জায়গা নষ্ট করা। কোনো অফিসের কেউ কোনো অপরাধ করলে, তার দায় একান্তই তার, অন্য কারও নয়। আমাদের এ বিষয়টিও বুঝতে হবে যে সরকারের সদিচ্ছার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকের দুর্নীতির থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসছে।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ২০ বছরে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে শত শত নিয়োগ দিয়েছেন। দায়িত্ব পেয়ে কেউ ভালো কাজ করেছেন, কেউ খারাপ কাজ করেছেন। কেউ দুর্নীতি করেছে, কেউ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, কেউ আবার ছিলেন অযোগ্য। যে যেমন কাজ করেছেন তার পুরস্কার বা তিরস্কার তিনিই পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মূল স্লোগান হলো সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বর্তমান সময়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে সুবিধাবাদী এবং সরকারি দলে অনুপ্রবেশকারীরা। এসব ইস্যুতে প্রায়ই দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। যারা ৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচারণসহ দলের নেতা-কর্মীদের নানাভাবে শোষণ করার চেষ্টা করেছে তাদের অনেকই এখন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে। ইদানীং নানাভাবে শোনা যায়, অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কিংবা এর ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোতে পদ বাণিজ্য হচ্ছে। ওই সব হাইব্রিড নেতাদের নিয়ে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। মূলত ৭৫ বছরের দলটির গৌরব, ঐতিহ্য, সাফল্য ও অর্জনের অজস্র ইতিহাস ও স্মারক থাকলেও নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও অন্য দল থেকে এসে কমিটিতে পদ পাওয়া অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে দলে বেশ সংকট রয়েছে। এ ধরনের সুবিধাবাদী নেতার কারণে সারা দেশে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়েছে; বেড়েছে সংঘাত ও সহিংসতা। মূলত গুটিকয়েক বিতর্কিত লোকের জন্য সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এমনকি সরকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাই এসব বিতর্কিতের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে জনমুখী কার্যক্রমের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্যই হলো জনগণের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা।

লেখক: ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


খিরমিজ খানের সফল জীবন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রাজীব কুমার দাশ

সফল পুত্র রাফসান খান। তার সফলতার জোয়ারে বাবা খিরমিজ খানের নকিয়া বাটন মোবাইল ফোন বিরতিহীন বেজে চলেছে। চাকরির বাজারে মডার্ন শর্টকাট ডিজিটাল কোচিং প্রক্সি প্রশ্নপত্র টেকনিক মাস্টারমাইন্ড সফল পুত্রের সফল বাবা খিরমিজ খান। খালাসি পাড়ার চা-দোকানি আফসারের দোকানে পায়ের ওপর পা তুলে মাঝেমধ্যে ভয়ংকর বিষধর রেটল সাপের মতো তার সমীপে ঔদ্ধত্যের ঝুমঝুমি বাজান। অসফল বাবাগুলোর কেউ কেউ- বাংলা খান সাহেব সন্তানদের ঈর্ষণীয় সাফল্য সফলতার স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন গল্প শোনেন। শোনেন - খান চাচার মাঝারি মেধাবী ধাঁচের সন্তানটি তর তর করে বদ্বীপের আনাচে-কানাচে নামে-বেনামে সামরিক-বেসামরিক ধূর্ততা চোখে আগ্রাসী সফলতা দুরবিন হাতে বেড়ে ওঠার গল্প। মুখে তার সন্তানই একমাত্র দেশসেরা। সফল পুত্র বিজ্ঞাপনে বিদ্রূপের পান পরাগ জর্দা রেসিপি ঠোঁটে ঔদ্ধত্যের জ্বলন্ত সিগারেট ধরিয়ে কখনো অসফল পিতা কখনো অসফল সন্তানকে কাছে ডেকে চা-দোকানিকে হুকুম করে বলেন-
আফসার
: জি স্যার।
- এদের চা দাও। বেলা টোস্ট বিস্কুট দাও।
: দিচ্ছি স্যার।
- আচ্ছা, জমির মণ্ডল - তোমার পোলাডা
দিয়া ত কিচ্ছু হইল না। এক কাম করো - পোলাডারে ইতালি পাঠিয়ে দাও।
: কাঁচুমাচু স্বরে অসফল পিতা মুনশি জমির উদ্দীন মণ্ডল বলেন –‘খান সাহেব। আমিও তো জানি। আমার সহজ-সরল ঢেবলা পোলাডারে দিয়া কিচ্ছু হইব না। কিন্তু কী করুম? এই পোলাডার চাকরির জন্য কত কত জায়গায় পাইকারি-খুচরা মনে ধরনা দিলাম। ইন্টারভিউ কার্ড আসে। পাস করে। ভাইভা বোর্ডে ঝড়ে যায়। রাজনীতি করি। নেতার সাথে জেল খাটলাম। নেতা এমপি-মিনিস্টার হইল। ছেলেটার জন্য বারবার যাই। নেতা বারবার আশ্বাস দেয় কিন্তু চাকরিটা হইল কই? অথচ দেখেন -আপনি আপনার বাবা সেই একাত্তর পেরিয়ে দুই হাজার চব্বিশ।

রিকশা ফ্রি জীবনে আপনি এখনো তরতাজা যুবক আছেন। গালে বয়সের ভাঁজ নেই, নেই চোখে মুখে হতাশা। অথচ দেখেন, একাত্তরের আগে হতে – ‘এখনো আমরা আপনাদের কথামতোন চলি। সংখ্যালঘু মনে- বৌ-ঝি ছেলে ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি
নিয়ে সব সময়ই টেনশন করি। বউটা ছেলে বায়েজীদের কিছু একটা হবে হবে ভেবে চিন্তা নিয়ে মরেই গেল।’

বায়েজীদের বাকি খাতার লাইনটা দীর্ঘ।
ও মুদি দোকানি। পুঁজিপাট্টা শেষের দিকে।

মাঝেমধ্যে সেই নেতা আবারও এলাকায়আসেন। নেতার মনে ভয় করলে বায়েজীদের ডাক পড়ে। ডাক পড়ে আজীবন ত্যাগের খাতায় নাম লেখানো রাজপথ কাঁপানো কর্মী জমির উদ্দিন মণ্ডলের। জমির উদ্দিনের চোখেমুখে এখনো সাহস আছে, কিন্তু নিঃস্ব পুষ্টিহীন জীবনে বল-শক্তি নেই। দলের দুর্যোগে, দলের সিংহভাগ সুবিধাভোগী নেতা-কর্মী যখন পালিয়ে পিকনিক করতে যায়; জমির উদ্দিনের হাতে থাকে -কালো চিমনির নিবু নিবু হারিকেল। নিবু আলোর টর্চ একটি লাঠি। কাজকাম নাই। দলের অফিস পাহারা দেয়। মাঝেমধ্যে থানার দারোগা ওসি ডাকে। ধমক দিয়ে বলে,অমুক তমুক নেতা কই? দলের দুঃসময়ে ত্যাগী কারোর যখন দেখা মেলে না, বড় নেতা পাতি নেতার ফোনটাও বন্ধ থাকে; কর্মী জমির মণ্ডল নেতা-কর্মীর পাশাপাশি পুলিশেরও সুখে-দুখে কাছাকাছি থাকেন। পাইকারি কিংবা খুচরা নেতা কর্মীদের গ্রেপ্তারে সিনিয়র অফিসার যখন ওয়াকিটকিতে কিছু করে দেখাতে বলেন; ডাক পড়ে জমির উদ্দিন মণ্ডলের। মস্তবড় সন্ত্রাসী খাতায় নাম লেখায়ে বারবার জেল খেটেছেন। বাঁচিয়ে দেন পুলিশ ও বড় নেতার মানসম্মান। দুকুলের ঘুম পাড়িয়ে জমির মণ্ডল জেলে নির্ঘুম থেকেছেন। বার বার কোর্ট হাজিরা জামিন নিতে গিয়ে উকিল খরচ, ভালো-মন্দ খাবার, বিড়ি খরচে বাবার দিনকার যা ছিল, সবই সস্তা দরে বিক্রি করেছেন। সম্মান কিংবা পুলিশের রিমান্ড ভয়ে মাস-বছর ধরে পালিয়ে যাননি। ক্ষমতার চিত্র- বিচিত্র পট পরিবর্তন, দেশের স্বার্থ দেখভাল পুলিশের ভাষা মুখে - জবাবদিহিতা স্বার্থের প্রয়োজনে জমির উদ্দিন মণ্ডল জেল খেটেছেন বছরের পর বছর।
জমিরের ছেলেটা এমপি সিনহার সবুজ কলম পানে তাকিয়েছিল বছরের পর বছর। সেই সবুজ কলমের সুপারিশে তার চেয়েও অযোগ্য বিরোধীপক্ষের নেতা-কর্মীদের দিয়ে সাজিয়েছেন প্রশাসনের চাকরির বহর।

এমপির উদ্বাহু হাসির অষ্টপ্রহরে ত্যাগী কর্মী চালচুলোহীন মনোদাস দলদাস জমির উদ্দিনের ছেলেটাকে উদ্যোক্তা হতে হলো।
এমপি সাহেব ধূর্ত সোহাগ মিশ্রিত ধমকের

সুরে বলেন,- ‘বায়েজীদ, তুইত নেতার ছেলে নেতাই হবি। সরকারি চাকরি করে চাকর হবি ক্যান?’

তুই কি সরকারি চাকরি করে চাকর হবি? না - বাণিজ্য বসতি লক্ষ্মী মনে বাকি জীবনটা গড়ে নিবি? তোর বাবা একটা বোকাচোদা বে-আক্কেল। অর্ধেক জীবন তোর চাকরির জন্য আমার কানে কানে ঘ্যানর ঘ্যানর করেছে। বাবার মতোন হলে বাকি জীবনটা না খেয়ে থাকবি। কাছে আয় -মাথাটা পেতে দে। দোয়া করে দিলাম। খাবি দাবি খলখলাবি সামনে থানা সন্মেলন আছে। তুই - খিরমিজ খান সাহেবের দলের হয়ে কাজ করবি।

বাকি খাওয়া সামাজিক অধিকার মনে বায়েজীদের দোকানের পুঁজি প্রায় শেষ। ধারদেনা পশুপাখি মাছ মুরগি ব্যবসা সামলিয়ে শেষ সম্বল ঘর ভিটে মাটি নীলাম হাঁকাল ব্যাংক।

এদিকে নারীবাদীদের প্রবল আপত্তির মুখে রত্নগর্ভা মা পুরস্কার -২০২৪ বন্ধ হয়ে গেল। খেতাব মেডেল আগে ভাগেই খিরমিজ খান সাহেবের স্ত্রী পারুল বেগমের নামে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের লিস্টে ছিল। আচমকা নারীবাদীদের আপত্তির মুখে মন্ত্রণালয়কে পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করতে হলো। বাজেট শেষ করতে হবে মনে, -সফল বাবা সম্মানে এই বার প্রথম চালু হলো –’ সফল বাবা পুরস্কার -২০২৪। '

সফল পুত্র ক্যাটাগরি বিচারে খিরমিজ খানই হবেন সফল বাবা। তার বড় ছেলে জজ। এক মেয়ে ইউএনও ছোট ছেলেটাও বিসিএস পুলিশে এসেছে। তাকে আটকায় কে?
হতে পারে - তার ছেলে মেয়েরাও তার মতো স্বাধীনতা বিরোধী। বেছে বেছে তাঁরা প্রতিদিন হত্যা করেন - স্বাধীনতার অবশিষ্ট চেতনা নিঃশ্বাস বিশ্বাস। কিন্তু তাতে কী? কার এমন বুকের পাটা দুঃসাহস? সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করবেন? করে দেখান তো? সফল বাবা পুরস্কার - ২০২৪ খিরমিজ খান পাচ্ছেন -এমনটাই চূড়ান্ত।

পুরস্কার সাফল্যে উদ্বেলিত সর্বসাকুল্যেভরা
-খান খিরমিজের দেহ মন। আজ শুক্রবার।

সরকারি বন্ধ। বিসিএস সন্তানরা সবাই বাড়িতে এসেছেন। মেজবানে একপাতে সবাই খাবেন। এসেছেন, থানা পুলিশ উপজেলা প্রশাসন। এক টেবিলে এমপি সাহেবও খেতে বসেছেন। স্পেশাল আয়োজনে গরুর নলা দেশি মুরগি খাসির কষা ভুনা। এমপি সাহেব টুক টাক সাংকেতিক কথামালা টুংটাং চামচ হাতে খেয়ে চলেছেন।

ওসি ইউএনও সাহেব আগে ভাগে খাবার শেষ করে রুটিন মাফিক সন্মান দিতে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি
হট্টগোল। জজ সাহেবের ক্লাসমেট ত্যাগী নেতার ছেলে বেকার বায়েজীদ চেয়ার টেনে পাশে বসেছেন।

সফল পিতা খিরমিজ খান ধমক দিয়ে বলেন,

এই হাবলা! জানিস ও কে? ও এখন তোর ক্লাসমেট নয়- ‘জজ '। জজের মানে বুঝিস!? সে ইচ্ছে করলে তোকে পুলিশ দিয়ে সবার সামনে পেটাতে পারে,ইচ্ছে মতো সবার সামনে গালিগালাজ করতে পারে। তোর হাত দুটো করজোরে গড়ে দিতে পারে ইচ্ছে ভাস্কর্য। তার ইচ্ছে ছাড়া কোর্টে একটি কথাও কেউ কইবার পারে না। সে চলে জমিদারের মতোন। চাইলে তোদের সবকটিকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে দিতে পারবেন। এগুলো বড়দের খাবার, তোর জন্য সেরেলাক মেজবানি টেবিল। খানের সাথে সাথে হো হো করে সবাই হাসেন।

- ওকে দেখ। সে এখন ইউএনও। এইদিকে দেখ - সে পুলিশের এসপি। যাকে তুমি শেখ সাবের ছবি ছেঁড়ার কারণে চড়
মেরেছিলে? হারামজাদা ছ্যাবলা কোথাকার। খান সাহেবের তর্জন গর্জনে কাঁপছে খাবার প্যান্ডেল। এমপি সাহেব ভয়ার্ত চাহনীতে এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখেন, - জজ ইউএনও পুলিশ ত্রিমুখী ধমকে দেহরক্ষী সেবক পুলিশও উনার ধারে কাছে নাই ,শেষমেশ এমপি সাবও খিরমিজ খানের গুণকীর্তন গাইলেন।

খিরমিজ খান সাহেব এমপির দিকে তেড়ে এসেছেন। প্রাইভেট পাবলিক অনলবর্ষী নেতা কর্মী নাই। পুলিশগুলো বদ্বীপের বিমূর্ত ভাবনার চিত্রপট হয়ে মমি মনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। এমপি সাহেবকে 'এইমাত্র সমুদয় টাকা ফেরত নিতে হবে। নচেৎ প্রকাশ্যে পেটাবে ' খিরমিজ খান সময় বেঁধে দিলেন।

ফাঁকা হয়ে গেছে খাবার প্যান্ডেল। কোথাও কেউ নেই। ভেসে আসছে কিছু মীরজাফর সময়ের অট্টহাসি। এই অট্টহাসি জাতির পিতা ও শেখ রাসেল দেখেছিল। বুকভরা সাহসে পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিল -তোরা আমার কাছে কী চাস?
কেঁদে কেঁদে মৃত্যুর হিমশীতল পরশে ছোট শিশু দুরু দুরু বুকে বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’

এমপি সাহেবের চোখের সামনে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে যাপিত সময়ের চিত্রকল্প। ভেসে আসছে সন্তান স্বামী হারা ত্যাগী নেতা কর্মীদের কিছু মানব হরিণী কান্না। বদ্বীপের ঘরে ঘরে সপরিবারে হত্যার অনুকল্প স্মৃতি দাসের ভেলা চেপে ভেসে আসছে পিতার না বলা কথা; শিশু রাসেলের অব্যক্ত কস্টের হাকাকার।

এমপি সাহেব কাঁপছে। ভুলগুলো হয়ে গেছে এক একটি প্রকাণ্ড বনস্পতির শাখা প্রশাখা শিকড়। চিৎকার করে বলছে -
' তোমরা কে কোথায়? তোমরা আমার প্রাণের সন্তান ভাই ভাতিজা। বলো -আমার কাছে কী চাও? সবুজ কালির সুপারিশে জজ ইউএনও এসপি বানিয়ে আমি এমন কী অপরাধ করেছি?।

চতুর খিরমিজ খানের পরিকল্পনা স্বার্থক হতে চলেছে। খিরমিজ খানের সফল পুত্ররা পরম নির্ভরতার চাদরে এমপি সিনহাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন। পেশাদার ডাকাত যেমন নিজেদের রক্ষাকবচ মনে করে প্রভাবশালী কারোর হয়ে কাজ করেন; গ্রেফতার সময়ে গোপনে পুলিশকে বিভ্রান্ত করে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন; পালিয়ে যাবার পরে পুলিশের ডাকাত ধরতে না পারা ব্যর্থতা নিয়ে তীব্র ভাষায়:
গালমন্দ করেন, সেভাবে খান সাহেবেরও সফল পুত্ররা উপস্হিত পুলিশ এসকর্ট ডেকে বহুমুখী তীব্র কর্কশ তিরস্কৃত মুখে বলেন:
‘সরকার আপনাদের বেতন দেয় কেন?। '

সিনহা চাচার এমন বিপদে আপনারা পাশে না থেকে কেন দূরে সরে গেলেন?’

এসকর্ট দলনেতার উত্তর: স্যার। আমরা দেখেছি,খান চাচা মানে আপনার আব্বিজান ও এমপি স্যার দুজনে সুখে দু:খে পাশে থেকেছেন, উনারা এক ও অভিন্ন।

আমরা প্রথমে মনে করেছি,তাঁরা দুষ্টুমি করে চলেছেন; হবেন হয়তোবা কোনো ওয়েব সিরিজের মনিটাইজেশন রিহার্সেল। পরে এমপি স্যারের কাঁপন দেখে বুঝতে পেরেছি, আপনার আব্বিজান প্রচণ্ড রকমের মাইণ্ড করেছেন।
খান চাচার রাগ এখনো কমেনি। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা খেতাবটুকুন চাইই চাই। এমপি সাহেব এতদিন গড়িমসি করেছেন। উপজেলা সন্মেলন কক্ষে বিভিন্ন চেয়ারম্যানের সামনে আইন শৃঙ্খলা মিটিং মুখে এমপি সাহেব উপস্হিত থেকে শোনাবেন স্বয়ং - কীভারে বগলে ঘাড় চেপে ধরে একজন দু'জন নয়, তিনজন খান সেনা মেরেছেন। গুণধর সন্তান পিতা খিরমিজ খান চাচার এ জীবনে এটাই শেষ আবদার।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক বাংলাদেশ পুলিশ।


হারানো দিন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

দিন চলে যায়। প্রতিদিন ভোরের সূর্যটা ক্ষয়ে দেয়, জীবনে বরাদ্দ সময়ের ভাণ্ডার থেকে। সময়ের পেণ্ডুলাম স্থির থাকে না। এদিক-ওদিক করে, সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা কে একক ধরে এগিয়ে যায়, রচিত হয় দিন, বছর, কাল থেকে মহাকাল। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না কষে যাপিত জীবনের চাকার ঘূর্ণন যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে বেরিয়ে আসবে গত হয়ে যাওয়া যাপিত জীবনের পদাবলি। যা আপাদমস্তক দিয়ে গেছে কখনো ক্ষীণ সুখ, হালকা ভালো থাকা আর যোগ হয়েছে, নীল বিষে দংশিত ঠকে যাওয়া অপাঙক্তেয় জীবন বোধের গল্প।

বিশ্বাসের ঘরে বাঘ:

যাদের সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস, অবলম্বন ভেবে, মানসিক, অর্থনৈতিকভাবে বন্ধু বানিয়ে সব দেওয়া, সে-ই করোনার দোহাই, দাপ্তরিক দোহাই, এই সপ্তাহ না পরের সপ্তাহ, সামনের মাস, হাজারো মিথ্যাচারে সব সুখ, ভালো থাকাকে ঝুলিয়ে দিয়েছে, কষ্টের দীর্ঘশ্বাসের ফাঁসিতে। যাকে সবচেয়ে বিশ্বাস করা হয়, সে-ই ঠকিয়ে দেয়। বাইরে স্বজন সেজে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে অদৃশ্য বিষ লক্ষার ছুরি।

কাছের মানুষ বা স্বজন চেনা:

যারা জীবিকার তাগিদে বাড়ি ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে, শহরবাসী হয়ে যান, তাদের বেঁচে থাকাই যেন আজন্ম পাপ হয়ে দাঁড়ায়। সবাই তাঁকে ঠকিয়ে, বঞ্চিত করে, মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে সুখের ঢেঁকুর তোলেন। লুকিয়ে আগেই দলিলাদি করে প্রাপ্তির থলি ভারী হয়ে গেলে, সবকিছু গুছিয়ে এনে ফাইনালি কাজের সময় বলে, ‘আমার দরকার নাই, তুই একাই কেইসে লড়।’ শহরে থাকা মানুষটি যে সারা জীবন জমি জমা দলিল, পর্চা, খারিজ নামজারি বুঝেনি, তার সাথে মায়ের পেটের ভাইদের এহেন আচরণে অসহায় হয়ে পড়ে। সহায় সম্পদ নিয়ে কত হিসাব, বারবার মাপামাপি, অযুতাংশও চলে আসে হিসাবের ধারাবাহিকতায়। মিথ্যা মামলা, মোকদ্দমা, প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগনামা দাখিল করে নিজেরা যেমন ছোট হয়ে যায়, তেমনি বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়ে, বুঝেও না বোঝার ভান ধরে, স্বার্থের সর্বশেষ পেরেকটা মেরে, সম্পর্কের বারোটা থেকে চৌদ্দ বাজিয়ে দিয়ে যায়। কেউ তাদের মূল্যায়ন করে না, পাত্তা দেয় না।

ঠকানোর মহোৎসব:

সংসারের আপন, স্বজন, রক্তের বাঁধনে আবদ্ধ মানুষটি দূরে থাকার সুযোগে, ঠকিয়ে জমি জমা নিজের সন্তানদের গোপনে লিখে দিয়ে, বাইরে আপন মানুষের অভিনয় করে, ঠকে যাওয়া মানুষটির বিশ্বাস, তার মন, অনুভূতি কে তুড়ি মেরে সামনে এসে বলে ভালো মানুষির কথা, ‘আমি চাই সম্পদের ভাগ, সমভাবে সবাই পাক’। মুখোশের আড়ালে সম্পর্কের সিলমোহরে লুকিয়ে থাকা এসব বন্ধুকে চিনতে চিনতে মধ্যবয়সে আজ। ঠকানো, অপছন্দ ও হিংসার বিষে জর্জরিত হয়ে, নিজেও অর্থনৈতিক মাইর খেয়ে ওদের দলেই নাম লিখে দীর্ঘশ্বাস সঙ্গী হলো। ওদের সাথে পা বাড়িয়ে সব আনন্দ, ভালো লাগাকে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত করে, এখন ওপর থেকে মলম দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। সব সম্পর্কের কবর রচনা করে মলিনতায় ভরিয়ে দেয় জীবনবোধ আর সুচিন্তার কথামালা।

অতীত নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করা যায়, ভালো-মন্দ যায়ই হোক। আর বর্তমান জেগে থাকে সুখ, দুঃখ, হাসি আনন্দের মালা গেঁথে। তাহলে ভবিষ্যৎ? অতীতের অভিজ্ঞতা মানুষকে সামনে আগানোর পথ দেখায়। কিন্তু যারা পরিবারের তথা সমাজের বিষফোঁড়া, মুখোশের আড়ালে বেড়ে উঠা শত্রু, তাদের চেনা, বোঝা, ধারণ করা- ‘খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো।’ বহমান জীবনের চলার পথে ভালো মানুষের বড্ড অভাব। জীবন তো চলমান এক নদী। এর শেষকথা বা উপসংহার তখনই হয়, যখন তার আর অস্তিত্ব থাকে না। লোক দেখানো আপনজন সেজে, কাছের মানুষটির অস্তিত্ব নিয়ে টানা হেঁচড়া, মিথ্যা মামলা, দখল বাণিজ্য, সমাজের তথাকথিত মানুষের জন্য ডাল-ভাত হয়ে গেছে। পারিপার্শ্বিক যাতনাবোধ দল বেঁধে এসে নতুন আনন্দকে আর ছুঁতে দেয় না। তারপরও স্বপ্ন দেখে মানুষ। বাঁচার অবলম্বন খোঁজে বেড়ায়। একটু ভালোমানুষির খড়কুটো কোথাও কেউ দেখালে সেদিকেই হাত বাড়ায় আগামীদিনের প্রত্যাশায়।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক


ওয়াদা বা অঙ্গীকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
এস এম মাহমুদুল আলম

আমরা মানবজাতি সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন বিষয়ে নানা অজুহাতে, স্বেচ্ছায়, অনিচ্ছায় একে অপরের সঙ্গে ওয়াদা করি। চাই তা লেনদেনের ক্ষেত্রে হোক আর কাজের ক্ষেত্রেই হোক। যখন কোনো ওয়াদা করা হয়, তখন তা মুমিন ব্যক্তির জন্য পালন করা অত্যন্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। কারণ মুমিনের জীবনে ওয়াদা পালন করার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ওয়াদাসমূহ পূরণ করো।’ (সুরা মায়িদা: ১)

এমনকি আখিরাতে অপূরণ ওয়াদা সম্পর্কে ব্যক্তি জিজ্ঞাসিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওয়াদা পূরণ করো, নিশ্চয়ই ওয়াদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা ইসরা: ৩৪) অপর দিকে যারা ওয়াদা পালন করে, তারাই খোদাভীরু। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা ওয়াদা করে তা পূরণ করেছে, তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সুরা বাকারা: ১৭৭)

যে লোক নিজ (ওয়াদা) প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে এবং পরহেজগার হবে, অবশ্যই আল্লাহ পরহেজগারদের ভালোবাসেন। যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য বিনিময়ে বিক্রয় করে, আখেরাতে তাদের কোনো অংশ নেই। আর তাদের সঙ্গে কেয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না। তাদের প্রতি (করুণার) দৃষ্টিও দেবেন না। আর তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না। বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। (সুরা ইমরান: আয়াত ৭৬-৭৭)

বাস্তবেই যারা ওয়াদা পালন করে না, তারা সমাজে হেয় ও তুচ্ছ হয় এবং সামাজিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ এটিও ঋণ সমতুল্য। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মুমিনের ওয়াদা ঋণ সমতুল্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে আমানত রক্ষা করে না, তার ঈমান নেই এবং যে অঙ্গীকার পালন করে না, তার দীন নেই।’ (ইবন হিব্বান) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ওয়াদা ভঙ্গকারীকে মুনাফিকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি। তা হলো কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে এবং আমানত রাখলে খিয়ানত করে।’ (বুখারি) ওয়াদা পালন না করা ব্যক্তিদের ধমক দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা যা করো না, তা বলো কেন? তোমরা যা করো না, তা বলা আল্লাহর কাছে বড়ই ক্রোধের বিষয়।’ (সুরা সফ: ২-৩)

ওয়াদা বা অঙ্গীকার কিম্বা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা মুমিনের অন্যতম গুণ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ প্রসঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো। অবশ্যই অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৩৪)

অন্যত্র মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করো।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ১)

আরও ইরশাদ করেন, ‘আর আল্লাহর অঙ্গীকার পূরণ করো। (আল-আনআম, আয়াত: ১৫২)

অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘(বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরা এমন) যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না।’ (সুরা রাদ, আয়াত: ২০)

মহান আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করার পর সে অঙ্গীকার পূর্ণ করো।

(সুরা নাহল, আয়াত: ৯১)।

অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হারাম ও মুনাফেকি

মহানবী (সা.) বলেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই।

অনুরূপ যে ব্যক্তি অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার মধ্যে দীন নেই।’ (বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা: ১৫)

তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি: কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে চারটি। চতুর্থটি হলো যখন বিবাদ করে, গালাগাল করে।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত, ১৭ পৃষ্ঠা)

হাদিসের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, অঙ্গীকার পূরণের সঙ্গে ঈমানের সম্পর্ক আছে। যার ঈমানের ঘাটতি রয়েছে, সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। আর এর ফলে আল্লাহ তায়ালা শত্রুদের তাদের ওপর প্রবল ও শক্তিশালী করে দেন।

আল্লাহ তায়ালা তার বিরুদ্ধে বাদী হবেন...

হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি বিচার দিবসে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। ১. যে ব্যক্তি অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে, ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে এবং ৩. যে ব্যক্তি কোনো কর্মচারী নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না’ (সহিহ বুখারি)।

অঙ্গীকার ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ

মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো নেতার আনুগত্যের অঙ্গীকার করে, তার উচিত সাধ্যমতো তার আনুগত্য করা (মুসলিম)। তাই কাউকে বৈধ কোনো কিছুর প্রতিশ্রুতি দিলে বা অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করা আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

ওয়াদা করে তা পূর্ণ করাই ইসলামের বিধান এবং সাওয়াবের কাজ। আর ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করা গোনাহের কাজ। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা ঠিক রাখা-না রাখা উভয় বিষয়ের লাভ ও ক্ষতির বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেন।

আল্লাহ তায়ালা সুরা ইমরানের ৭৬-৭৭ নং আয়াতে বলেন,

‘যে লোক নিজ (ওয়াদা) প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে এবং পরহেজগার হবে, অবশ্যই আল্লাহ পরহেজগারদের ভালোবাসেন। যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য বিনিময়ে বিক্রয় করে, আখেরাতে তাদের কোনো অংশ নেই। আর তাদের সঙ্গে কেয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না। তাদের প্রতি (করুণার) দৃষ্টিও দেবেন না। আর তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না। বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব।’

আয়াতের সার সংক্ষেপ আল্লাহ তায়ালা এ দুই আয়াতের একটিতে ওয়াদা ঠিক রাখার ফজিলত এবং অন্যটিতে ভঙ্গ করার নিন্দা ও শাস্তির বিবরণ বর্ণনা করেছেন। আগের কিছু আয়াতে ইয়াহুদিদের প্রতারণা ও মিথ্যা দাবির কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে নৈতিক উন্নতি ও উত্তম আচরণের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাকওয়া। আর তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়ই মানুষকে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে আগ্রহী করে তোলে। তাই ওয়াদা তথা প্রতিজ্ঞা সৃষ্টির সঙ্গে হোক আর স্রষ্টার সঙ্গে হোক তা পূর্ণ করা আবশ্যক ও ফজিলতপূর্ণ কাজ। আল্লাহ তায়ালা এদের বেশি ভালোবাসেন। পক্ষান্তরে মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার স্বার্থে ওয়াদা ভঙ্গকারীদের নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়েছেন। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের কাছে পরাজয় বরণ করে ওয়াদা ভঙ্গ করলে এর ক্ষতিও মরাত্মক। এ আয়াতে ৫ ধরনের ক্ষতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর তাহলো- ওয়াদা ভঙ্গকারীর জান্নাতের নেয়ামতে কোনো অংশ নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ দ্বারা কোনো মুসলমানের অধিকার নষ্ট করে, সে নিজের জন্য জাহান্নামের শাস্তিকে অপরিহার্য করে নেয়। বর্ণনাকারী বলেন, যদি বিষয়টি সামান্য হয়, তবুও কি জাহান্নামের শাস্তি অপরিহার্য? তিনি বললেন, ‘তা গাছের একটা তাজা ডালই হোক না কেন।’ (মুসলিম)

অতএব সামান্য কয়েকটি মুহূর্তের দৃশ্যমান আনন্দের জন্য, মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো অবস্থাতেই ভুলেও না, কখনো অযথা ওয়াদা বা অঙ্গীকার করা সমীচীন হবে না।

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ


গ্রামগঞ্জে উন্নয়নের জোয়ার: তবে এই উন্নয়ন টেকসই হওয়া প্রয়োজন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
শাখাওয়াত হোসেন

সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ এত বেশি এগিয়ে গেছে যে, যেখানে হাঁটার রাস্তা ছিল না, সেখানে এখন চলছে ট্রাক। যেসব এলাকার মানুষ কখনও চিন্তাই করেনি বিদ্যুতের আলো দেখবে, তারা এখন বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিই শুধু দেখছে না, এর মাধ্যমে নানা কুটির শিল্প, ব্যাটারিচালিত গাড়ির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ অনেক সহজ করে ফেলেছে। এখন আর মানুষ পরমুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকে না, নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য নানা কিছু উদ্ভাবন করছে। আর এতে ভালো ফলও পাচ্ছে। জেলা শহর এবং উপজেলা সদর এমনকি বাজারেও পৌঁছে গেছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা। মানুষ আগে ৬/৭ এমনকি ১০ মাইল হেঁটে সপ্তাহে দুইবার বাজারে যেত। বর্ষাকালে হাঁটু পানি এমনকি কোমর পানি মাড়িয়ে হাটে-বাজারে যেতে হতো। এখন বাড়ির সামনেই অটোরিকশা, সিএনজি আর ব্যাটারিচালিত রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষের টাকা-পয়সারও কোনো অভাব নেই। সংসারের একজন বা দুইজন বিদেশে থাকে। সেখান থেকে রেমিট্যান্স পাঠায় আর তা দিয়ে বেশ ভালোভাবে জীবনযাপন করছে। তবে একটি বিষয় খুব পীড়া দেয়, সেটা হলো চাষাবাদ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই হাটে যায় আর চালের বস্তা কিনে বাড়ি ফেরে। চাষাবাদের জমিগুলো আগাছায় ভরে গেছে। এসব আগাছা সাফ করে কারও আর এখন ফসল বোনার দিকে মনোযোগ নেই। সবকিছু শটকাট হয়ে গেছে।

গ্রামের ফসলি জমিতে এখন আর ফসল ফলে না। এগুলো হয়তো অনাবাদি আর না হয় এগুলোতে নতুন নতুন বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। বিপুল ফসলি জমি এখন বাড়িতে পরিণত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বোধ হয় আবাদি জমি আর থাকবে না।

এবার কোরবানি ঈদে বাড়িতে ছিলাম। আমার বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার কাজির হাট এলাকায়। ঈদের দিন এবং পরের দিন পুরো এলাকা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। সংবাদপত্রে চাকরি করলে ছুটি পাওয়া যায় না। সপ্তাহে এক দিন ছুটি পেলেও ঢাকায়ই কাটাতে হয়। এবার ঈদের ছুটির সঙ্গে এক দিন সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়ায় চার দিন বাড়িতেই ছিলাম। কোরবানি ঈদের পরের দিন পুরো এলাকা ঘুরে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। এ সময় দেখলাম পুরো উপজেলায় অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটের এত উন্নয়ন হয়েছে, মানুষ ঘর থেকে বের হয়েই অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত রিকশায় মুহূর্তে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। কোথাও কোনো কাঁচা রাস্তা চোখে পড়েনি। রাস্তা পাকা শেষ হওয়ার পর এখন বাড়ির সদর দরজা এমনকি উঠানও কোথাও কোথাও পাকা হয়ে যাবে হয়তো। আগে রাস্তার পাশে পুকুরে রাস্তা যাতে ভেঙে না পড়ে সে জন্য গাইড ওয়াল দেওয়া হতো, এবার দেখলাম পুকুরে তো দেওয়া হয়েছেই, জমিতেও গাইড ওয়াল দেওয়া হয়েছে।

তবে এত উন্নয়ন দেখে যেখানে মন ভালো হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। কারণ যা কিছু উন্নয়ন হচ্ছে তার সবই প্রায় নড়বড়ে। অর্থাৎ দুই-তিন মাস আগে যে রাস্তা করা হয়েছে বা রাস্তার পাশে যে গাইড ওয়াল দেওয়া হয়েছে তা ইতোমধ্যে ভেঙে পড়েছে। মাত্র দুই-তিন মাসে আবারও তার পাশেই গাইড ওয়াল দেওয়া হচ্ছে। আর এই গাইড ওয়াল শুধু ইট আর বালু দিয়ে কোনো রকমে খাড়া করে দেওয়া হচ্ছে। এই গাইড ওয়ালও যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে- এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। দেখার যেন কেউ নেই। দেখে মনে হলো সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল। যে যেভাবে খুশি টাকা কামানোর ধান্দায় আছে। কারও কোনো দেশপ্রেম নেই। সবার একই উদ্দেশ্য কীভাবে টাকা কামিয়ে বড় লোক হওয়া যায়। দেশ জাহান্নামে যাক। যারা এসব কাজের ঠিকাদারি নিচ্ছেন, দেখে মনে হলো তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। যারা কাজ করাচ্ছেন সেই সরকারি দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা কখনও সরেজমিন দেখতে আসেন না। তারা কিন্তু ঠিকাদারের কাছ থেকে যা সুবিধা নেওয়ার নিয়ে থাকেন। কিন্তু দোষ দেন ঠিকাদারের। এলজিইডির এক কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ভাই বাদ দেন। যারা এসব কাজ নেন তারা দলীয় লোক। আমরা কিছু বললে আমাদের ওপর চড়াও হন। কী বয়ানটাই না তিনি দিলেন। নিজে থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর দোষ দেন সরকারি দলের লোকদের। তারা একদিকে নিজেরা টু পাইস কামাচ্ছেন, অন্যদিকে পুরো দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন সরকারি দলের লোক বা ঠিকাদারদের ওপর।

প্রতিটি কাজের টেন্ডার হওয়ার আগে তা যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়। দরপত্রের আগে হিসাব করেই ঠিকাদারের লাভসহ দরপত্র আহ্বান করা হয়। ঠিকাদাররা একজোট হয়ে কে কোন দরপত্রে অংশ নেবে, তা ঠিক করে রাখে। এ কারণে কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই তারা কাজ পেয়ে যায়। তারপরও ঠিকাদাররা নয়ছয় কাজ করে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের বিবেক বলতে কিছু নেই। কোথাও কোথাও কাজ করার আগেই গাইড ওয়াল ভেঙে পড়ছে। কারও যেন কোনো মাথ্যব্যথা নেই। এলাকাবাসী এদের বিরুদ্ধে কথা বলে না। তারা নাকি পার্টি করে, তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই তারা চড়াও হয়। সে কারণে কেউ মুখ খোলে না।

বর্তমান সরকারের আমলে যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে বা হচ্ছে তা অন্য কোনো সরকারের আমলেই হয়নি। অথচ এত উন্নয়নের পরও মানুষ সন্তুষ্ট নয়। প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কেন সন্তুষ্ট নয়। এসব অনিয়মের কারণেই মানুষ আজ অতিষ্ঠ। চোখের সামনে বড় ধরনের অনিয়মেও মানুষকে চুপ থাকতে হচ্ছে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাতদিন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করছেন। তিনি সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছেন। অথচ কিছু অসাধু এবং দুর্নীতিবাজ মানুষের জন্য তার সব অর্জন আজ ভেস্তে যেতে বসেছে। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি যাদের মায়া নেই, যাদের বিবেক নেই, সেই বিবেকহীন মানুষগুলোই আজ গ্রামগঞ্জে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আর নিজেদের পকেট ভারী করছে। এসব অসাধু ও দুর্নীতিবাজ মানুষের জন্য যেমন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, তেমনিভাবে দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে তাও টেকসই হচ্ছে না।

এই সরকারের উন্নয়নমুখী রাজনীতি সারাবিশ্বে প্রশংসিত। অনেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাসিনার কাছে জানতে চান তার এই জাদুকরী উন্নয়নের রহস্য কী। তারাও বাংলাদেশের উন্নয়নের রোলমডেল তাদের দেশে প্রয়োগ করতে চান। কিন্তু আমদেরই কিছু লোক এই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। ওপরে ওপরে উন্নয়নের জিগির তুললেও ভেতরে ভেতরে টাকা কামানোর ধান্দায় ব্যস্ত তারা।

বাংলাদেশে যে পরিমাণ উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন যদি টেকসই হতো, তাহলে আগামী ৫/৬ বছর এ খাতে কোনো টাকার প্রয়োজন হতো না। এ টাকা অন্য খাতে খরচ করে আমাদের আরও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল।

আমাদের দেশে অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। বড় প্রকল্পগুলোতে জবাবদিহি থাকায় সেগুলো টেকসই হচ্ছে। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও তা টেকসই না হওয়ায় সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে মানুষ খুশি হতে পারছে না। অথচ যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, তার যদি ৭০/৮০ ভাগও যথাযথভাবে ব্যবহার হতো তাহলে দেশের যেমন উন্নয়ন হতো, তেমনি আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারতাম।

আরেকটি ব্যাপারে সবার দৃষ্টি দেওয়া উচিত। তা হলো সব আবাদি জমি আস্তে আস্তে ঘরবাড়িতে রূপান্তর হচ্ছে। অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি নির্মাণের ফলে এমন হচ্ছে। দেখা যায়, একটি পরিবারের মাত্র তিন-চারজন সদস্য হলেও আবাদি জমিতে বিশাল বাড়ি তৈরি করা হয়। এসব ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সবাই মিলে দেশকে ভালোবাসতে হবে। দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে। শুধু নিজের আখের গোছাতে থাকলে মাত্র কয়েকজন মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে। আর বাকি মানুষগুলোকে আজীবন কষ্টই করতে হবে। দেশের সবক্ষেত্রে সব মানুষের উন্নয়ন না হলে তাকে উন্নয়ন বলে না। উন্নয়নের জন্য সবাইকে সমানভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উচিত যারা সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের টাকা যথাযথভাবে খরচ না করে নয়ছয় করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। না হলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাতদিন পরিশ্রম করে দেশের উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতার কথা বলছেন, তা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। মাত্র হাতেগোনা কিছু দুর্নীতিবাজ লোকের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।

উন্নয়ন হচ্ছে, আরও হবে কিন্তু সে উন্নয়ন যাতে টেকসই হয়, সে জন্য যারা যেসব প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। না হলে উন্নয়ন শুধু মানুষ চোখেই দেখবে, এর সুফল পাবে না। সুফল না পেলে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট হবে না আর সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে না। তাই আমার বক্তব্য হচ্ছে উন্নয়নের যে জোয়ার বইছে তা অব্যাহত থাকুক এবং তা যাতে টেকসই হয় তার যথাযথ ব্যবস্থা করা হোক।

লেখক: সাংবাদিক


উদ্ভাবনেও উৎসাহ দিতে পারে বাজেট ২০২৪-২৫

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান

২০২৪-২৫ অর্থবছরের খসড়া বাজেট সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতির এক কঠিন সময়ে বাজেটটি পেশ করা হয়েছে। তাই একে ঘিরে প্রবল জনমনোযোগ থাকার কথা। বাস্তবেও তাই দেখছি। প্রচুর কথা হচ্ছে বাজেটকে ঘিরে। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা ছাড়াও অন্য অংশীজনরাও কথা বলছেন। অর্থনীতিবিদরা তো বলছেনই।

তা ছাড়া ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন চেম্বার, নানা ধরনের নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এবং মতামত তৈরির প্রভাবক মহল প্রচুর কথা বলছেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে নানা মহলের এই আলাপ-আলোচনা এক অর্থে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ভিত্তিকে বেশ জোরদারই করছে বলা চলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক মাধ্যম।

যদিও সামাজিক মাধ্যমের বেশির ভাগ ব্যবহারকারী অনেকটাই যেমন খুশি তেমন বলতেই বেশি আগ্রহী তবুও এখানেও জনগণের চাওয়ার যথেষ্ট ইঙ্গিত মেলে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিশ্চয় সব মহলের সমালোচনা ও পরামর্শের নির্যাস নোট করছেন। যেহেতু এবারে ঈদের ছুটির কারণে খুব বেশি সময় ধরে সংসদের ভেতরে বাজেট আলাপ হওয়ার সুযোগ নেই তাই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের এসব আলাপকে বিকল্প সংসদীয় আলাপ মনে করে সেগুলো সংগ্রহ করে বাজেট-প্রণেতাদের চূড়ান্ত বিবেচনার জন্য নিশ্চয় সংক্ষেপে তুলে ধরা হবে।

খুব ভালো হতো যদি সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলো তাদের নিজ নিজ খাতের জন্য অন্তত তিনটি করে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় পরামর্শ অর্থমন্ত্রীকে দিতে বলতেন মাননীয় স্পিকার। অন্তত প্রকৃত অর্থনীতি সম্পর্কিত কমিটিগুলো (যেমন- অর্থ, পরিকল্পনা, বাণিজ্য, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জলবায়ু ও পরিবেশ ইত্যাদি) যদি সংসদে স্থাপিত হেল্পডেস্কের সাহায্য নিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য দু-একটি করে উপযুক্ত পরামর্শ অর্থ মন্ত্রণালয়ে স্পিকারের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে পারত তাহলে তা পর্যালোচনা করে খসড়া বাজেট অনেকটাই প্রাসঙ্গিক করার সুযোগ পাওয়া যেত।

একই সঙ্গে বাজেটকে তরুণদের অর্থবহ করার জন্য তরুণ উদ্যোক্তাগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের নানা সংগঠন (বিশেষ করে এসএমই ফাউন্ডেশন), বেসিস, ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন, নারী চেম্বার, তৃণমূলের নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন এবং অনলাইন ব্যবসায়ী তরুণ উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট বাস্তবানুগনীতি পরামর্শ সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে।
ট্রেড লাইসেন্স নেই বলে তাদের বাদ দেওয়া যাবে না। তাদের ব্যাংক হিসাব ও এমএফএস হিসাব থাকলেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে কয়েক মিনিটেই ছোট আকারের ঋণ দেওয়া সম্ভব।

তাদের অনেক ধারণা এখন ডিজিটাল স্পেসেও ভেসে বেড়াচ্ছে। উচিত হবে ধারণাগুলো পেশাগত দৃষ্টিতে সংগ্রহ করে বাজেট প্রণেতাদের সামনে উপস্থাপন করা। সীমিত অর্থের মধ্যেও যতটুকু গ্রহণ করা যায় ততই মঙ্গল। এতে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ নিশ্চয় বাড়াবে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে চলমান বাজেট আলোচনাকে এভাবেই আরও সময়োপযোগী করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে এখন যথেষ্ট সংখ্যক তরুণ মেধাবী কর্মকর্তা আছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও বিভিন্ন হেল্পডেস্কের প্রতিনিধিদের সহায়তা নিয়ে আসলেই গতানুগতিক বাজেট আলোচনাকে আরও উদ্ভাবনমূলক ও জনসম্পৃক্ত করতে সাহায্য করতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এবারের বাজেটের ভালো ও মন্দ দিক নিয়ে বাজেট পেশের আগে থেকেই তুমুল আলাপ হচ্ছিল। বাজেট পেশের পরেও যথেষ্ট আলাপ ও লেখালেখি হচ্ছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটকে আরও অর্থবহ করার জন্য আমার দিক থেকে কিছু নীতি পরামর্শ রাখতে চাই।
এক. ঘরে ও বাইরের নানামুখী চ্যালেঞ্জকে আমলে নিয়েই একটি প্রাসঙ্গিক বাজেট দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সময়ের দাবি মেনে এবং মূল্যস্ফীতিকে এক নম্বর সমস্যা বিবেচনা করে মুদ্রানীতির সঙ্গে মিল রেখে অনেকটাই সংকোচনমূলক বাজেট পেশ করা হয়েছে। এই ধারাকে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ রয়েছে।

দুই. উন্নয়ন বাজেটে এখনো অনেক অপ্রয়োজনীয় এবং অগ্রাধিকারে বাইরের প্রকল্প মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক চাপাচাপির কারণে রয়ে গেছে। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে এগুলো হয় বাদ কিংবা অযথা ডালপালা কেটে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হবে-এমন একটি প্রস্তাব সংসদে পাস করা যেতে পারে।

তিন. মূল্যস্ফীতিকে যেহেতু কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না তাই কৃষি, জ্বালানি বিশেষ করে সোলার শক্তি, এমএসএমই ও নারী উদ্যোক্তা, ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের জন্য আরও প্রণোদনামূলক বিশেষ অর্থ বরাদ্দ করা হোক। এই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক, এমআরএ, এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফকে দেওয়া হোক।

এরা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদে পর্যাপ্ত ভর্তুকির জন্য এই অর্থ ব্যবহার করবে। কোভিডকালে তারা এই কাজটি ভালোভাবেই করেছে। তাই নতুন করে আর চাকা উদ্ভাবন করার দরকার নেই। তারা পারবে।
চার. সব ব্যাংককে এমএফএসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ন্যানো ক্রেডিট ব্যবস্থা চালু করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের লভ্যাংশের একটি অংশ সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়কে না দিয়ে এই ন্যানো ক্রেডিট ব্যবহারকারী অংশের সুদ ভর্তুকির দেওয়ার মাধ্যমে ছোটখাটো ডিজিটাল ও নারী উদ্যোক্তাদের হ্যান্ডহোল্ড করে তুলে আনতে উদ্যোগ নেবে।
ট্রেড লাইসেন্স নেই বলে তাদের বাদ দেওয়া যাবে না। তাদের ব্যাংক হিসাব ও এমএফএস হিসাব থাকলেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্য নিয়ে কয়েক মিনিটেই ছোট আকারের ঋণ দেওয়া সম্ভব। সিটি ব্যাংক এবং বিকাশ, বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেটরি সমর্থন নিয়ে এই কাজটি করছে। অন্য ব্যাংকগুলোও সামাজিক দায় সম্পন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এই সহযোগিতার কাজে যুক্ত করা সময়ের দাবি। বাজেটে এ জন্য আলাদা কিছু বরাদ্দ থাকলে এ কাজে গতি আসবে।
পাঁচ. বাজেটে কৃষিসহ প্রকৃত খাতকে আরও বিনিয়োগ সহায়তা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে চরে সবুজ বিদ্যুৎ ও সার ব্যবহারের সুযোগ বাড়ানোর জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং এমআরএর সহযোগিতায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাজার উন্নয়নমূলক কিছু প্রকল্প নিশ্চয় নেওয়া সম্ভব।

বাজেটে কৃষিসহ প্রকৃত খাতকে আরও বিনিয়োগ সহায়তা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে চরে সবুজ বিদ্যুৎ ও সার ব্যবহারের সুযোগ বাড়ানোর জন্য গ্রামীণ উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং এমআরএর সহযোগিতায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাজার উন্নয়নমূলক কিছু প্রকল্প নিশ্চয় নেওয়া সম্ভব।

এমফোরসি, ফ্রেন্ডশিপ এবং বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চরের কৃষিতে সবুজ জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। সোলার ইরিগেশন পাম্প, প্রাকৃতিক পণ্য স্টোরেজ ব্যবস্থাসহ নানামুখী উদ্ভাবনী বীজ তারা তৈরি করছে। বগুড়ার আরডিএও তাদের সক্রিয় অংশীদার।

ছয়. বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে অনেক ব্যাংক তাদের সামাজিক দায়বদ্ধ তহবিল থেকে কৃষির উদ্ভাবনে নতুন নতুন প্রকল্পে স্থানীয় এনজিওকে যুক্ত করেছে। ভুট্টা চাষ, সোলার ইরিগেশনসহ অনেক উৎপাদনশীল কাজে ব্যাংকগুলো অর্থ ঢেলেছে।
এই কাজটি আরও বেশি করে করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজেটারি খানিকটা সহায়তা দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। বিশেষ করে চরের কৃষিবাজারকে চাঙা করার সুযোগ এ ধরনের বাজেটারি সমর্থন খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

সাত. কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি বিশেষ ইনোভেশন তহবিল করা হোক। একটি স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ সমৃদ্ধ জুরি বোর্ডের মাধ্যমে এই অর্থ সবুজ জ্বালানি, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য ‘আর অ্যান্ড ডি’ তহবিলের আওতায় উৎসাহী ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আট. এবারের বাজেটে জলবায়ু ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ একটি অভিযোজন তহবিল দেওয়া হয়েছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। একই রকমভাবে আরও ১০০ কোটি টাকার আরেকটি তহবিল এ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হোক সুন্দরবনের প্রাণী ও প্রকৃতিকে রিমাল-উত্তর পুনর্বাসন ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য।

তবে শর্ত থাকুক যে এ তহবিল বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সবুজমুখী উদ্ভাবন ও গবেষণাভিত্তিক অ্যাকশন রিসার্চে ব্যবহার করা হবে। এ জন্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
এই রকম আরও অনেক প্রস্তাবই আমরা দিতে পারি। তবে সংসদ যদি এমন উদ্ভাবনীমূলক জনবান্ধব বাজেটারি পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে উৎসাহ দেওয়ার পক্ষে প্রস্তাব নিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের বাজেটকে সত্যি সত্যি অংশগ্রহণমূলক করার নতুন দুয়ার খুলে দেওয়ার কৃতিত্ব নিশ্চয় আমাদের আইনসভা নিতে পারে।

সবশেষে বলব এবারে দারুণ এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে দেওয়া হয়েছে বাজেট। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যা যা করা দরকার তা তো করবেনই সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পাশাপাশি আগামী দিনের টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করার জন্য জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজ গড়ার জন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনের উদ্যোগও নিতে হবে আমাদের সরকার ও রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকেও এসব উদ্ভাবনের অংশীদার হতে হবে। মনে রাখা চাই রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো। তিনি বলে গেছেন, মানুষের জ্ঞান ও প্রকৃতির দান মিলেই তৈরি হয় সভ্যতা। আমাদের বাজেটসহ অর্থনীতির মূল সুরটিও যেন এ সভ্যতার বিকাশে সারথি হয় সেই প্রত্যাশাই করছি।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক


যুক্তরাজ্যে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলা টাউন সরগরম 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. আজিজুল আম্বিয়া

সম্প্রতি সংসদ ভেঙে দিয়ে যুক্তরাজ্যে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। দেশটিতে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সুনাক এ বছরের ৪ জুলাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০নং ডাউনিং স্ট্রিট থেকে। সংবাদমাধ্যম বিবিসির মাধ্যমে জানা যায়, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে মন্ত্রীদের এ ব্যাপারে অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। এরপর তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সময়ে সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। দেশের নিয়মানুযায়ী মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের আগে রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছে যান তিনি। সেখানে সংসদ ভেঙে দেওয়া ও নতুন নির্বাচন আয়োজনের জন্য রাজার অনুমতি চান তিনি। রাজা চার্লস অনুমতি প্রদানের পরেই এটি জনসম্মুখে ঘোষণা করেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ১০৭টি কাউন্সিলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরোধী দল লেবার পার্টির কাছে ব্যাপক ধরাশায়ী হয় ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি, হয়তো এ কারণেই এরকম একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। গত নির্বাচনে স্যার কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টি ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টির তুলনায় বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। বলা যায়, বিগত ৪০ বছরে এবারই কনজারভেটিভ পার্টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমন ধরাশায়ী হলো। এখন পর্যন্ত ২১ জন বাঙালি এমপি প্রার্থীর নাম জানা গেছে যারা এই নির্বাচনে লড়ছেন। এই কারণে এই নির্বাচন বাংলাদেশিদের মনে আনন্দ আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ বলে চিন্তা পোষণ করছেন। এদিকে যুক্তরাজ্যের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পাননি দলটির সাবেক প্রধান জেরেমি করবিন। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বরাবরের মতো লন্ডনের ইসলিংটন নর্থ আসন থেকে নির্বাচন করবেন করবিন। এতে ওই আসনে পরাজয়ের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে লেবার পার্টি। করবিন ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত লেবার পার্টির নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বেই ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেয় লেবার পার্টি। সেই দল থেকে ২০২০ সালে করবিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে লন্ডনের ইসলিংটন নর্থ আসন থেকে জয় পেয়ে আসছেন করবিন। লেবার পার্টির প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম না দেখে তিনি নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। করবিন বলেছেন, ‘সাম্য, গণতন্ত্র ও শান্তির পক্ষে একটি স্বাধীন কণ্ঠস্বর’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ওই আসন থেকে নির্বাচন করবেন তিনি। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমি চাই, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেন গণতান্ত্রিক হয়। তবে ইসলিংটন নর্থে লেবার পার্টির সদস্যদের নিজেদের (পছন্দের) প্রার্থী বেছে নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ৭৪ বছর বয়সি করবিন বলেন, ‘আমাদের একটি পদক্ষেপ নিতেই হতো। সোচ্চার হয়ে বলতেই হতো, আমরা এটা আর মেনে নিতে পারছি না। আমরা নিজেদের অধিকার আদায় করেই ছাড়ব। এ কারণেই ইসলিংটন নর্থের মানুষের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। ১৯৮৩ সাল থেকে ইসলিংটন নর্থ আসনে টানা নির্বাচিত হয়ে আসছেন করবিন। ২০২০ সালে লেবার পার্টি থেকে করবিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দলে তার নেতৃত্বের সময় ইহুদিবিরোধী অভিযোগগুলো তিনি কীভাবে সামলেছেন এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাকে দল থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় লেবার পার্টি। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলার নিন্দা জানিয়ে আসছেন করবিন। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যে একাধিক বিক্ষোভেও অংশ নিয়েছেন তিনি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির সরকারে সামগ্রিক নীতির বড় সমালোচক করবিন। এমনকি গাজায় ‘জাতিগত নিধনের’ অভিযোগ তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রতি আহ্বান জানানো রাজনীতিকদের একজন তিনি। এদিকে কঠিন সমীকরণে কনজারভেটিভ দল। এখন পর্যন্ত ৭৮ জন এমপি পদত্যাগ করেছেন। ফলে ৪ জুলাই জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চরম বেকায়দায় পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। এ ঘটনা ২৭ বছর আগে ১৯৯৭ সালে ভরাডুবির আগের চিত্রকেও হার মানিয়েছে। তখন এই দলের ৭২ জন এমপি পদত্যাগ করেছিলেন। এদিকে এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে লেবার পার্টি। বর্তমানে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ঋষি সুনাকের দলের চেয়ে স্যার কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টি ২০ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, এই নির্বাচন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হবে, যখন বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। তিনি এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি তার প্রচারের মূল বিষয় করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে কি কি কর্মকাণ্ড চালাবে এর মধ্যে ফিলিস্তিন একটি রাষ্ট্র হওয়া উচিত কি না বিবিসির সাংবাদিকের করা এ রকম প্রশ্নের জবাবে স্টারমার বলেন, হ্যাঁ, আমি মনে করি। আমি মনে করি ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরাইলের পাশাপাশি একটি কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রয়োজন। স্বীকৃতি প্রদানটা এই কার্যক্রমের অংশ হতে পারে। বাংলাদেশের ৪ জন এমপি বিগত দিনে এই সংসদে বিজয়ী হয়েছিলন একসঙ্গে। তখন থেকে বাঙালি পাড়ায় নির্বাচনের সময় আনন্দ-উৎসব শুরু হয়। চলে ক্যাম্পেইন দিনরাত। সবার অপেক্ষা শুরু হয়েছে কবে তাদের পছন্দের প্রার্থীর আবার বিজয় হবে। এ নিয়ে বেশ সরগরম বাঙালিদের শহর বলে খ্যাত বাংলা টাউন। এই এলাকায় দেখা যাচ্ছে রুশনারা আলীর ক্যাম্পেইন পরিণত হয়েছে মহোৎসবে। লেবার পার্টির বিপুল সমর্থকদের দখলে থাকা আসন থেকে যদি এই চারজন সংসদ সদস্য পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন এবং লেবার পার্টি ব্রিটেনে ক্ষমতায় আসে, তাহলে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় অন্তত একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্থান পেতে পারেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বাংলাদেশিদের মধ্যে মন্ত্রী পদের লড়াইয়ে লেবার পার্টির ভেতরে চারবারের এমপি রোশনারা আলী ও তিনবারের এমপি বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিকের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। ইস্ট লন্ডন লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বাউ, পপলার ও লাইমহাউস আসনে লেবার পার্টির মনোনীত প্রার্থীর এমপি হওয়া আরও নিশ্চিত। রুশনারা আলী গত চারটি নির্বাচনে লেবারদের জন্য পূর্ব লন্ডন লন্ডনের সবচেয়ে নিরাপদ ও নিরাপদ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। সিলেটের বিশ্বনাথের ভুরকি গ্রামে জন্ম নেওয়া ৪৯ বছর বয়সি রুশনারা এই আসনে লেবার পার্টির প্রার্থী। তিনি ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে লন্ডনে চলে আসেন। ইস্ট লন্ডন আসনে গতবার স্থানীয় লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশধরদের বিরোধিতার মুখে লেবার মনোনয়ন ও নির্বাচনী লড়াইয়ে জয়ী হন অপ্সনা বেগম। গত নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী অপ্সনা প্রায় ২৯,০০০ ভোটে কনজারভেটিভ প্রার্থী শিউন ওককে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ৩৪ বছর বয়সি, উদ্যমী ভদ্রমহিলা টাওয়ার হ্যামলেটসের শ্যাডওয়েলে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন। তার বাবার বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। অপ্সনার বাবা মনির উদ্দিন টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলর ছিলেন। তিনি আসন্ন নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী তালিকায় সংক্ষিপ্ত প্রার্থী। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসনের তিনবারের এমপি। ৪১ বছর বয়সি টিউলিপকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা লেবার পার্টির মধ্যে নতুন প্রজন্মের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে মূল্যায়ন করেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে, টিউলিপ প্রথমবারের মতো লেবার পার্টির অনিরাপদ আসনে একটি উত্তপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে জয়লাভ করেন। লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভায় দুবার দায়িত্ব পালন করা টিউলিপ সিদ্দিক আসন্ন নির্বাচনে জয়ী হলে এবং তার নিজের দল লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলে মন্ত্রিসভায় তার স্থান হবে বলে অনেকে মনে করছেন। রূপা হক তৃতীয়বারের মতো লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়ে লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল আসনে টানা এমপি হন।

৫২ বছর বয়সি ব্রিটিশ বাংলাদেশি মেয়ে রাজনীতিতে আসার আগে লন্ডনের কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান পড়াতেন। কলামিস্ট ও লেখক সর্বশেষ কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বাংলাদেশ থেকে মোহাম্মদ হক ও রওশন আরা হকের তিন কন্যার মধ্যে রূপা হক সবার বড়। তার বাবা-মা ১৯৭০ সালে ব্রিটেনে আসেন। তার বাবার বাড়ি পাবনা শহরের কুঠিপাড়ায়। সহজ-সরল ও বিনয়ী আচরণের জন্য রূপা হক তার নির্বাচনী এলাকার ভেতরে এবং বাইরে বেশ পছন্দের। এবার জনমত জরিপে লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন রূপা হক। এদিকে পরিবর্তনের সময় বলে বেথনাল গ্রিন এবং স্টেপনি থেকে এমপি হিসেবে বাঙালি মেয়ে রাবিনা খান লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি থেকে লড়ছেন। তিনি এই এলাকার উন্নয়ন করতে চান জানান, উল্লেখ্য, তিনি ১২ বছর স্থানীয় কাউন্সিলর ছিলেন এবং হাউস অফ লর্ডসের একজন বিশেষ উপদেষ্টাও বটে। তার পক্ষেও চলছে ক্যাম্পেইন। ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিকরা ব্রিটেনের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হতে দেখছেন সবাই, ব্রিটেনে বসবাস করছেন প্রায় দেড় মিলিয়ন বাংলাদেশি কিন্তু কোনো বাংলাদেশি এখনো মন্ত্রী হতে পারেননি। এই দেশের বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে লেবার পার্টি সরকার গঠন করলে এবং লেবার পার্টি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বর্তমান চার সংসদ সদস্য পুনরায় নির্বাচিত হয়ে আসেন তবে হয়তো কোনো এক নতুন বাঙালি ইতিহাস গড়ার সুযোগ পাবেন। তাই সব বাংলাদেশিদের যার যার অবস্থান থেকে এসব বাংলাদেশি প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করার সুচিন্তিত মতামত পোষণ করেন সুশীলরা।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক।


banner close