মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নতুন করে পাল্টা শুল্ক কর আরোপ করার সময় থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশে ফেরার পর গতকাল বিষয়টি নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন তিনি। ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কর আরোপের কারণগুলো খতিয়ে দেখা হয়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বেশি রপ্তানি করে তুলনায় দেশটি থেকে আমদানি কম হওয়ার কারণেই এই পাল্টা শুল্কভার চেপে বসায় অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উপায় হতে পারে সেখান থেকে পণ্য আমদানি বাড়ানো। ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ শেষে বের হয়ে ব্রিফিংয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন এসব তথ্য জানিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর বিষয়টি সরকার গভীরভাবে বিবেচনা করছে।
এছাড়া নতুন শুল্ক নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে শুল্ক আরোপ করার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আজকের সভা হয়েছে। এখানে উপদেষ্টা পরিষদসহ অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিল। নতুন এই অবস্থায় বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করার ক্ষেত্রে আমরা আমদানি বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করছি। শুল্ক ছাড়াও আমাদের বাণিজ্যের বিষয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধা আছে। সেগুলো অপসারণ করলে আমাদের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করি।
তিনি বলেন, ভিয়েতনাম, চায়না, কম্বোডিয়া এসব প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের পণ্য অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে দিতে পারে বলে আশাবাদী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতেও শুল্ক বেড়েছে, তাই যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক নীতিতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং বাংলাদেশের তৈরি পোশাকে বৈচিত্র্য থাকায় সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে।
এছাড়া, প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বলেও জানান তিনি।
সেখানে উপস্থিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমান বলেন, আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা এখনো যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় আলোচনায় আছি। দু-এক দিন এই আলোচনা চলবে। আমরা তাদের থেকে ইতিবাচক সাড়া পাব বলে ধারণা করছি।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার (২ এপ্রিল) ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত ২টা) হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যেখানে বাংলাদেশি পণ্যে এতদিন গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল।
হোয়াইট হাউস প্রকাশিত চার্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের ওপর ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। তাই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ ‘ডিসকাউন্টেড রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ ধার্য করা হয়েছে।
ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর ২০ শতাংশ, কম্বোডিয়ায় ৪৯ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪৪ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৩৬ শতাংশ, তাইওয়ানে ৩২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৩২ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডে ৩১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩০ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৫ শতাংশ, জাপানে ২৪ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৪ শতাংশ, ইসরায়েলে ১৭ শতাংশ, ফিলিপাইনে ১৭ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১০ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১০ শতাংশ, তুরস্ক, ব্রাজিল, চিলি এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১০ শতাংশ করে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টাকে যেসব পরামর্শ দিয়েছে এনবিআর
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে বড় অঙ্কের শুল্ক বসানোর প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের মধ্যে যে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, সেখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তরফে সরকারি বিভিন্ন আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ থাকছে।
এলএনজি ও গমসহ যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা সম্ভব এবং সরকারেরও প্রয়োজন তা সেখান থেকেই বাড়তি খরচ হলেও আমদানি করে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য এনবিআরের পরামর্শের বিষয়টি বলেছেন সংস্থার একজন কর্মকর্তা।
এনবিআরের নীতি শাখার ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, এর বাইরে তারা কিছু পণ্যের তালিকা করে দিয়েছেন, যেগুলোর আমদানি শুল্ক কমানো যায়।
এদিন এনবিআরের নীতি শাখা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা পণ্যের আমদানি পর্যায়ে কত শুল্ক রয়েছে, কোথায় কত প্যারা ট্যারিফ বা শুল্ক রয়েছে এবং তা থেকে কত শুল্ক আদায় হয় তা বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষণ প্রস্তুত করেছে বলে এ কর্মকর্তা বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমেরিকা থেকে যে পণ্য আমরা আনি, যেখানে বলা হয়েছে যে আমরা ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছি, এটা ভুল। আমাদের রিভিউ করে দেখা গেছে, আমাদের ইফেক্টিভ রেট হচ্ছে ৫ শতাংশেরও কম। তার মানে হচ্ছে, আপনি যদি ইমপোর্ট না বাড়ান, আর আপনি যদি ডিউটি (শুল্ক) জিরোও করে দেন, লাভ নাই। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, ইমপোর্ট ডিউটি জিরো করলেও যে ইমপোর্ট বাড়বে তা কিন্তু না।’
প্রসঙ্গত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের শতাধিক দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ৩৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের মুখোমুখি হবে। এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ, যা এখন বেড়ে হল মোট ৫২ শতাংশ।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা জানান, এনবিআর ১০টি পণ্যের তালিকা তৈরি করে দিয়েছে এর মধ্যে বাল্ব, জেনারেটর, জেনারেটিং সেট, ইলেকট্রিক্যাল আইটেম এসব রয়েছে।
তবে এসব পণ্যের শুল্ক কমালেই যে আমদানি হবে সে নিশ্চয়তা নেই তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে যদি ইমপোর্ট (আমদানি) বাড়াতে হয় তাহলে সরকারের কিছু ফোর্স ইমপোর্ট (আমদানি) বাড়াতে হবে। যেমন গতবছর গভর্নমেন্ট এলএনজি ইমপোর্ট করেছে, এ বছর করে নাই। এটা করতে পারে। গম, এগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিনতে পারে।’
অন্য দেশ থেকে না এনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনায় খরচ বাড়বে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ফিজিবল কিনা চিন্তা করার সুযোগ নাই।’
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির বাজার রক্ষায় এ পদক্ষেপ গ্রহণ করাই এ মুহূর্তে কার্যত সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।