ভারতের কলকাতায় নৃশংসভাবে খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলার অন্যতম দুই পলাতক আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও ফয়সাল আলী সাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আজ বুধবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত খাগড়াছড়ির পাতাল কালীমন্দিরের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের গ্রেপ্তারে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে ডিবির একাধিক টিম দুপুর থেকে খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে হেলিকপ্টার দিয়ে সাঁড়াশি অভিযান চালায় বলে জানা গেছে।
ডিবি জানায়, নাম-পরিচয় গোপন করে খাগড়াছড়ির পাতাল কালীমন্দির এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বী সেজে লুকিয়ে ছিলেন গ্রেপ্তার ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। তারা পলাশ রায় ও শিমুল রায় নাম ধারণ করেছিলেন। সনাতন ধর্মাবলম্বী সেজে তারা ২৩ দিন ওই কালীমন্দিরে ছিলেন।
গ্রেপ্তারের পর খাগড়াছড়ি থেকে দুই আসামিকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়। রাজধানীর পূর্বাচলে হেলিকপ্টারে নেমে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার খবর পাওয়া যায়, খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ে লুকিয়ে রয়েছেন ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। খবর পেয়ে ডিবির একটি টিম আগেই পাহাড়ে গিয়ে অভিযান শুরু করে। পরে আজ আমরা গিয়ে হেলিকপ্টার দিয়ে সাঁড়াশি অভিযান চালাই।
হারুন অর রশীদ বলেন, অজ্ঞান করার জন্য সংসদ সদস্য আনারের নাকে ক্লোরোফরম দেন ফয়সাল। আর মোস্তাফিজ আনারকে উলঙ্গ করে চেয়ারে বেঁধে রাখেন। শিমুল ভূঁইয়ার মূল দুই সহযোগী ছিলেন আজ গ্রেপ্তার ফয়সাল ও মোস্তাফিজ।
ডিবিপ্রধান আরও বলেন, খাগড়াছড়ির পাতাল কালী মন্দির এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বী সেজে পলাশ রায় ও শিমুল রায় নাম ধারণ করেন ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। নাম-পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশে সেই কালী মন্দিরেই থাকতেন দুজন। তারা ২৩ দিন ওই কালী মন্দিরে ছিলেন। আনারকে হত্যার পর ১৯ মে ফয়সাল ও মোস্তাফিজ দেশে ফেরেন।
১৯ মে রাতে আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে কথা বলেন ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। এরপর শাহীন তাদের মাত্র ৩০ হাজার টাকা দেন। এরপর তারা দুর্গম পাহাড়ের ওই কালী মন্দিরে চলে যান। তাদের দুজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে আরও তথ্য-উপাত্ত বের করা হবে বলেও জানান হারুন অর রশীদ।
হারুন বলেন, কলকাতার যে ফ্ল্যাটে এমপি আনারকে হত্যা করা হয়, সেই কিলিং মিশনে ছিলেন সাতজন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত শিমুল ভূঁইয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় হলেন ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। হত্যাকাণ্ডে মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এখন আমাদের মূল কাজ। এ ছাড়া এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে আমরা আইনের আওতায় আনব। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল মিলিয়ে মোট নয়জন গ্রেপ্তার হলেন হত্যার ঘটনায়।
পরে গ্রেফতারকৃত দুই আসামিকে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
ডিবি সূত্র বলছে, সন্দেহভাজন আসামিদের মধ্যে মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল এমপি আনার খুন হওয়ার আগে গত ২ মে কলকাতায় যান। তারা দেশে ফিরে আসেন ১৯ মে। এই দুজনকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল ডিবি। দুজনের বাড়ি খুলনার ফুলতলায়। খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী হিসেবে চিহ্নিত শিমুল ভূঁইয়ার বাড়িও একই এলাকায় এবং দুজনের ঘনিষ্ট। ফয়সাল ও মোস্তাফিজের কাছে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের অনেক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যাবে বলে জানিয়েছেন ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
গ্যাস বাবুর মোবাইল উদ্ধারে ঝিনাইদহের পুকুরে অভিযান
এদিকে, এমপি আনার হত্যা মামলার অন্যতম আসামি কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে নিয়ে তার ফেলে দেওয়া মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য আলামত উদ্ধারে ঝিনাইদহে চালানো অভিযান শেষ হয়েছে। তবে গ্যাস বাবুর ফেলে দেয়া কোনো ফোন এখনো পাওয়া যায়নি।
ঝিনাইদহের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারুক আযমের নেতৃত্বে বুধবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত জেলেদের পুকুরে নামিয়ে অভিযান চালানো হয়। অভিযান শেষ হলেও প্রাথমিকভাবে কোনো আলামত উদ্ধার হয়নি বলে জানা গেছে।
এরইমধ্যে দুপুর ১২ টার দিকে উদ্ধার অভিযান পরিদর্শনে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে ঝিনাইদহে আসেন ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ।
অভিযান শেষে ডিবি প্রধান বলেন, এ হত্যায় মোট ৭ জন অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ৫ জনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। বাকি দুজনকে গ্রেপ্তারে জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তারা নদী, সাগরে বা মাটির নিচে যেখানেই থাকুক না কেন আমরা তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবো। তবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না এবং অভিযুক্ত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। গ্যাস বাবুকে নিয়ে তার ফেলে দেওয়া মোবাইল ফোন তিনটি উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ সময় এমপি আনার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির সহকারী কমিশনার (ডিবি) মাহফুজুর রহমান, ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আজিম উল আহসানসহ পুলিশ কর্মকর্তরা উপস্থিত ছিলেন।
একদিন আগে গত মঙ্গলবার ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেছিলেন, বাবু আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাতে মোবাইল ফোনগুলো জলাশয়ে ফেলে দেয়ার কথা বেরিয়ে আসে। বাবুর জবানবন্দি অনুযায়ী, এক নেতার নির্দেশে তিনি ফোনগুলো আশপাশের কোনো নালা বা পুকুরে ফেলে দিয়েছেন। পানি থেকে আলামত উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি ও জেলেদের কাজে লাগানো হবে। স্থানীয় পুলিশ জলাশয়গুলো নজরদারিতে রেখেছে, যাতে কেউ ফোন সরিয়ে ফেলতে না পারে।
তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে প্রথমে বাবু দাবি করেন, মোবাইল ফোনগুলো হারিয়ে গেছে। তিনি এ ঘটনায় জিডি (সাধারণ ডায়রি) করেছেন। পরে নতুন তথ্য উঠে আসে, ফেলে দেয়া ওই ফোনগুলো দিয়েই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে বহুবার কথা বলেছেন বাবু। অসংখ্য মেসেজ ও তথ্য আদান-প্রদান করেছেন। তাই সেগুলোতে ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, তদন্ত চলমান থাকায় এখনই কে দোষী আর কে নির্দোষ, তা বলা যাচ্ছে না। তবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না। আবার কোনো দোষী ব্যক্তিকে ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। ভারতের কাছেও শাহীন মোস্ট ওয়ান্টেড। তাই ভারত চেষ্টা করবে শাহীনকে ফিরিয়ে আনার জন্য।
এর আগে গত ৬ জুন রাতে ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়া এলাকা থেকে গ্যাস বাবুকে আটক করে ডিবির একটি দল। বাবু ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। আনার হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শিমুল ভূঁইয়ার নিকটাত্মীয় এই বাবু।
প্রসঙ্গত, এমপি আনার চিকিৎসা জন্য গত ১২ মে দুপুরে দর্শনা-গেদে সীমান্ত হয়ে ভারতের কলকাতায় যান। প্রথম দু’দিন যোগাযোগ থাকলেও ১৪ মে থেকে পরিবারের সদস্যরা তার খোঁজ পাচ্ছিলেন না। পরে আনোয়ারুলের পরিবার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হয়। পরে ভারতের দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও কলকাতায় বাংলাদেশ উপ- হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর থেকে ওই সংসদ সদস্যের খোঁজে তদন্ত শুরু করে কলকাতা পুলিশ। সংস্থাটি জানায়, দিল্লি ও কলকাতা হাইকমিশনের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পরই তার খোঁজে তৎপরতা শুরু করে পুলিশ। পরে গত ২২ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনসের বিইউ ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটে এমপি আনারকে নৃশংসভাবে খুন করা হয় বলে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে।