শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকারের হস্তক্ষেপে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ভিসি অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ ও প্রোভিসি অধ্যাপক এস কে শরীফুল আলম অবশেষে পদত্যাগ করেছেন। গত বুধবার রাতে বিশেষ নির্দেশনা পেয়ে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।
এর আগে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সংকট নিরসন এবং শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সহ-উপাচার্যকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। অনতিবিলম্বে একটি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ দুটি পদে নতুন নিয়োগ প্রদান করা হবে। অন্তর্বর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখার স্বার্থে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের মধ্য থেকে একজনকে সাময়িকভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
দীর্ঘ ৬৫ দিনের আন্দোলন আর ৫৮ ঘণ্টার অনশনে ক্ষুধায় যখন শরীর ঝিমিয়ে আসছিল, তখনই সংবাদ এসেছিল শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্যকে অব্যাহতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাই গত বুধবার রাতের সেই সংবদে কুয়েটজুড়ে উঠেছিল আনন্দের বন্যা।
অনশনে থাকা শিক্ষার্থী সিভিল বিভাগের রাহাতুল ইসলাম বলেন, রাত সোয়া একটার দিকে ক্যাম্পাসে এসে তানজিম স্যার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো একটি পত্র আমাদের পড়ে শোনান। তাতে জানতে পারি ক্যাম্পাসের স্বৈরাচারী ভিসিকে সরকারের পক্ষ থেকে অপসারণ করা হচ্ছে। তখন থেকে ক্যাম্পাসে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে।
তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আমাদের পাশে ছিল বলে আমাদের এই বিজয় এসেছে। প্রত্যেকের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের যেকোনো ক্যাম্পাসে যদি কোনো ভিসি স্বৈরাচারী কার্যক্রম শুরু করেন তবে আমরা আবারও গর্জে উঠব।
১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে নানা কারণে আলোচিত উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে তারা আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
এর আগে বুধবার সকালে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার। সে সময়ে তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনশন প্রত্যাহার করানোর জন্য অনুরোধ করেন। তবে শিক্ষার্থীরা তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাদের হলের পানি, ইন্টারনেট বন্ধের কথা উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন। একই সঙ্গে ৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ও তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার ব্যাপারে অভিযোগ তোলেন।
উপদেষ্টা সেই সময়ে শিক্ষার্থীদের বলেন, আমার সঙ্গে দুইজন ইউজিসির সদস্য এসেছেন। তারা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে কুয়েট প্রশাসনকে অবহিত করবেন। তোমাদের এই যাবতীয় অসুবিধা দ্রুত সমাধান করা হবে।
তখন শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা দুই মাস ধরে আন্দোলন করে আসছি। তবে আমাদের দাবি মানা হচ্ছে না। আমরা এই বিষয়ে আর সময় দিতে চাই না। আপনারা আপনাদের কাজ করতে থাকেন। আমরা লাশ হয়ে গেলেও ভিসির পদত্যাগ ছাড়া অনশন ভাঙব না।
সে দিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তাদের সঙ্গে কোনো সভা করেননি। এরপর ইউজিসির সদস্যদের সাথে কুয়েট প্রশাসনের সভা হয়। পরে সাড়ে ১২টার দিকে জরুরি সিন্ডিকেটে বসিয়ে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও ক্যাম্পাসের হল খুলে দেওয়া হয়।
এরপর সরকার ও ইউজিসির নির্দেশে ভিসি ও প্রোভিসি পদত্যাগে বাধ্য হন।
এদিকে, ভিসি-প্রোভিসিকে অব্যাহতির সিদ্ধান্তকে ন্যায়বিচারের পরাজয় বলে মন্তব্য করেছে কুয়েট শিক্ষক সমিতি। গতকাল দুপুরে কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া ভিসি ও প্রো-ভিসির অব্যাহতির সিদ্ধান্ত ন্যায়বিচারের পরাজয়। আমরা চেয়েছিলাম একটা রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। কিন্তু বর্তমান সময়ে যারা রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের আন্দোলন করে আসছিল, আমরা দেখতে পাচ্ছি তারাই আজ অন্ধকার রাজনীতির করালগ্রাসে বন্দি। এ কারণে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ এ ক্যাম্পাসে উদ্ভূত সংকট নিরসনে শিক্ষকবৃন্দের কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি। শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়সহ তার প্রেরিত প্রতিনিধিদলও এ ক্ষেত্রে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। ফলে সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া চাপের মুখে ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের অব্যাহতির সিদ্ধান্তে মূলত ন্যায়বিচারের পরাজয় হয়েছে।
ড. মো. ফারুক হোসেন আরও বলেন, গৌরবান্বিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দীর্ঘ আট মাস পরেও যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এহেন কার্যক্রম চলতে থাকে, তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়; সমগ্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলতে পারে। যা নিয়ে শিক্ষক সমিতি উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তবে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকরা সব সময় সচেষ্ট থাকবে।
এ সময়ে তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় যারা দোষ করেছে, এই ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে অপসারণ দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অপরাধ যেটা সেটা অপরাধই, সেটা আমাদের ছাত্রদেরও দাবি শিক্ষকবৃন্দেরও দাবি। আমাদের পরিষ্কার অবস্থান এই বিচার নিশ্চিত করেই ক্লাসে ফিরতে হবে। তা না হলে শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত হবে না।
এদিকে, গতকাল উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ শরীফুল আলম শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে দাবি সম্বলিত একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি অব্যাহতি দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত অধিকতর তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।