গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের ফলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা ‘রহিত’ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
সোমবার নির্বাচন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আরপিওর ৯১এ ধারার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘৯১এ-তে কোনো ক্ষমতা রহিত হয় নাই, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাচ্ছি।’
নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) হেয় ও জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন সিইসি। তিনি বলেন, সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ইসি ভোট শেষে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট কিছু কেন্দ্রে ভোট বাতিল ও গেজেট প্রকাশ আটকে দেয়ার ক্ষমতা পেয়েছে। এতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও বেড়েছে ও সুসংহত হয়েছে।
আরপিও সংশোধন গেজেট আকারে প্রকাশের পর সার্বিক বিষয় নিয়ে নির্বাচন ভবনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন সাংবিধানিক সংস্থা ইসির প্রধান কাজী হাবিবুল আউয়াল।
পাশাপাশি ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা ‘খর্ব হয়েছে’ ‘নিজের পায়ে নিজে কুঠার মেরেছে’- এমন মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেন তিনি। সিইসির দাবি, ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা রহিত হয়নি। একটি বিধান সংশোধন নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, ইসিকে হেয় করা হচ্ছে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, দীর্ঘ ক’মাসে আইনটি নিয়ে নানা বক্তব্য এসেছে। তাতে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে। এ জন্য যেসব ব্যাখ্যা, মন্তব্য এসেছে তার সবগুলো সঠিক নয়। এ জন্য ইসির পক্ষ থেকে আমরা স্পষ্টীকরণ করতে চাই।
সরকার নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন করেনি
নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার আইন সংশোধন করেনি দাবি করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘সরকার আমাদের সম্মান দেখিয়েছে। আমরা যেটা চেয়েছিলাম সেটা নাও করতে পারতেন সেটা সরকারের অধিক্ষেত্র। কিন্তু আমরা যেটা চেয়েছিলাম, সেখানে সরকারে সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। তারা আমাদের প্রস্তাবিত সংশোধনগুলো সংসদে নিয়ে পাস করে দিয়েছে। দু-চার দিন আগেই একটা পত্রিকায় বলা হয়েছে, কমিশন থেকেই ক্ষমতা কমানো প্রস্তাব গিয়েছে। এটি একেবারেই অবান্তর। কমিশন কখনোই তার ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব পাঠায়নি। পাঠাতে পারেও না। আর এতটা দায়িত্বহীন কমিশন হবে, এটা চিন্তাও করা যায় না। কিছু কিছু জায়গায় ‘পোলিং’ এবং ‘ইলেকশন’ শব্দের কথা বলেছে। আমরা তিনটা জায়গায় ইলেকশন শব্দের পবিবর্তে পোলিং দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছি। এটা হলো ক্লারিক্যাল কারেকশন। ক্লারিক্যাল কারেকশন এবং অ্যামেন্ডমেন্ডের মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। অ্যামেন্ডমেন্ডের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য থাকে, যেটা অর্থকে পরিবর্তন করে দেয়। ক্লারিক্যাল কারেকশন হচ্ছে জাস্ট সংশোধন। পানি বানান করতে গিয়ে উ-কার দিয়ে ফেলেছিলাম, কেউ সেটা ই-কার দিয়ে করতে পারে, যেটা কারেকশন। এটাকে নিয়ে অপব্যাখ্যা করাটা দুঃখজনক বলে মনে করি।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করব যারা বিজ্ঞজন আছেন, আমরা পুরো জাতি প্রত্যাশা করছি একটা সুন্দর নির্বাচন হোক। নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনকে হেয় করা বা খাটো করা যেমন বাঞ্ছনীয় নয়, যেমন নির্বাচন কমিশনকে তারা যদি গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন, আমরা উপকৃত হব। আমরা যেকোনো গঠনমূলক সাজেশন বিবেচনায় নিতে সদা প্রস্তুত। আগামী নির্বাচনটাকে সুন্দর করার জন্য আমরা প্রত্যাশা করি যেকোনো আইন বা বিধিবিধানে ভালো কোনো সংশোধন সম্ভব হয় আমরা হয়তো আগামীতেও করব।’
শুধু ৯১-এ নয়, বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সুসংহত করেছে বলে মনে করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, যেমন ৮৪এ –তে দেখবেন বেশ কিছু কর্মকে আমরা অপরাধের আওতায় এনেছি। যেমন গণমাধ্যম কর্মী তাদের ইক্যুপমেন্টকে যদি কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত করে, পর্যবেক্ষকদের দেহ এবং তাদের কোনো ইুক্যুপমেন্ট যদি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান এনেছি।
তিনি বলেন, ‘মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় বাধা দেয়ার অভিযোগ আসে। এই ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য আমরা বাধাদানকারীকে শাস্তির আওতায় এনেছি। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে কাউকে চাপ প্রয়োগ করলেও সেটা অপরাধ হবে। তবে এগুলো কমে আসবে। কেননা, অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের ব্যবস্থা করছি। ইতোমধ্যে কিছু মনোনয়নপত্র অনলাইনে রিসিভ করতে পেরেছি। এতে শোডাউন এবং অর্থব্যয় কমে যাবে। চট্টগ্রাম-১০ ও ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচনেরও আমরা অনলাইনে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে পেরেছি। ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দিলে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে, এটাও আরপিওতে একটা ইম্প্রুভমেন্ট।’
‘আরেকটি বিষয় কেউ প্রশাংসাও করেননি, সমালোচনা বা আলোচনাও করেননি। প্রিজাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এতে তিনি যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা না পান তবে ভোট বন্ধ করে সব কাগজপাতি ফেলে বেরিয়ে আসবেন। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা দায়িত্ব স্পষ্ট করা। এতে তিনি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে সেটা ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাকেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
৩১(২)-তে আগে শুধু ছিল ব্যালট পেপারে। এখন সেখানে স্বাক্ষরের বিধানও এনেছি। ভোট গণনার সময় ব্যালটে স্বাক্ষর না পেলে সেটা বাতিল করা হবে। আরেকটা বিষয় হলো আবেদনের ভিত্তিতে এজেন্টদের রেজাল্ট দেবেন। কিন্তু এখন বলা হয়েছে আবেদনের ভিত্তিতে নয়, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এমনিতে সেটা দেবেন।
কারও প্রার্থিতা আমরা বাতিল করতে পারি। কিন্তু সে আবারও নমিনেশন জমা দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে আমরা বিধান এনেছি কারও যদি অপকর্মের কারণে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়, তাহলে সে পরবর্তী সময়ে নতুন নমিনেশন দাখিল করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে এটা একটা অগ্রগতি।
কমিশন ভুল করতে পারে কুঠার মারে নাই
‘ইলেকশন’ শব্দটির পরিবর্তে ‘পোলিং’ শব্দটি কেন আনা হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘ইলেকশন শব্দটা হচ্ছে জেনাস। ইলেকশনের আন্ডারে পোলিং। পোলিংয়ের আন্ডারে কখনো ইলেকশন হয় না। তো যেটা হচ্ছে, একটা নির্বাচন করে যিনি নির্বাচিত হলেন, উনি পোলড হবে না, উনি নির্বাচিত হবেন। আর পোলিংটা হবে যেই অংশটাতে ভোটাররা গিয়ে ভোট দিবেন। ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়াটাকে পোলিং বলা হয়। আমাদের আরপিওতে দেখবেন, ইলেকশন আর পোলিং শব্দটা ডেফিনেশনে আছে। কাজেই এই জিনিসটা বুঝবেন। এটাকে বিশাল করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, যে নির্বাচন কমিশন তার পায়ে কুঠার মেরে ফেলেছে। নির্বাচন কমিশন ভুল করতে পারে কিন্তু কুঠার মারে নাই। আমরা বলছি, এটা সুচিন্তিতভাবে এটা কারেকশন করেছি। এখানে আসলে ইলেকশন হবে না, পোলিং হবে।’
সিইসির দাবি কমিশন ভোট বন্ধ করতে পারবেন
নির্বাচনের আগে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কমিশন ভোট বন্ধ করতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, 'নির্বাচনের আগের দিন ভূমিকম্প হয়ে লক্ষ লোক মারা গেছে, কমিশনের কিছু ইনহেরেন্ট পাওয়ার আছে, কমিশন পারবে না কেন? অনিয়ম যদি হয়, নির্বাচনের আগে, আমাদের বিধান আছে তদন্ত করতে হবে। তদন্ত করে অনিয়ম যিনি করেছেন তার প্রার্থিতা বাতিল করার সুস্পষ্ট একটা বিধান আছে। আমরা যদি দায় নিরূপণ করতে পারি কে অনিয়ম করেছেন, তাহলে তার প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন চালিয়ে নিতে পারব।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, ‘আপনাদের উদ্দেশে বলার কারণ হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে মন্তব্য এসেছে। এতে করে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে যে এতে করে আমরা মনে করি যেসব ব্যাখ্যা এসেছে তা সবগুলো সঠিক নয়। যেমন প্রথম যেটা বলা হয়েছিল, কমিশন বুঝে না বুঝে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে। এবং কমিশন গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল এবং ৯১(এ)-তে সংশোধন এসেছে। আসলে তা হয়নি। সেটা হুবহু আগের মতোই আছে। ৯১এ(এ)-তে নতুন একটি ধারা সংযোজিত হয়েছে। সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য আরপিও সংশোধন করেছে- এমন মন্তব্যও এসেছে। কিন্তু সরকার আরপিও সংশোধন করে নাই। করেছে, তবে আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী। নির্বাচন কমিশন তার অবস্থান আরও সংহত, দৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য যে সংশোধনগুলো চেয়েছিল সে সংশোধনগুলোতে সরকার সম্মত হয়েছে। এতে আমাদের ক্ষমতা বেড়েছে। ৯১(এ)-তে সংশোধন হতো তবে আমাদের ক্ষমতা কিছু হেরফের হতো। যেহেতু ওখানে কিছু করা হয়নি, উটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা, যে পোংলি পিরিয়ডে আমরা যে একটি, দু’টি বা সব আসনের নির্বাচন আমরা বাতিল করে দিতে পারি। সেটা হুবহু আগের মতোই আছে।