আইন আকারে জারি হওয়ার আগে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী বিল নিয়ে আগাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি মন্তব্যের জন্য ‘অপেক্ষা’ করতে বলেন।
ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমিয়ে আরপিও সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে গত মঙ্গলবার। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) সদস্যদের আপত্তির মুখে এ বিল পাস হয়। যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে দাবি করেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি।
বিলটি আইন হিসেবে পাস হওয়ার অপেক্ষা করছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘যে বিলটা পাস হয়েছে, আমি অপেক্ষা করছি আইনটা হোক। এখনো আইন পাস হয়নি। বিল পাস হয়েছে। বিল এবং আইন এক নয়। বিল যেটি পাস হয়েছে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি সম্মতি দেন, তাহলে এটি আইন আকারে গেজেট হবে। তখনই বলা সমীচীন হবে।’
‘এর আগ পর্যন্ত আমি নিশ্চিত নই...। পরে আমি অবশ্যই কথা বলব। বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলব আমাদের অবস্থানটা’, বলেন সিইসি।
আরপিওর ৯১-এর (ক) ধারার প্রসঙ্গ এলে হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি কোনো কথা বলব না। একটু ওয়েট (অপেক্ষা) করেন। বিলটা মনে হয় দুই-এক দিনের মধ্যে জানতে পারব, মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন কি না। তখন বলাটা সমীচীন হবে।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, ‘আমরা আপনাদের বলব। বিস্তারিত আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেব। বিলটা সম্পর্কে...একটু এটাকে আইন হতে দেন। এ বিষয়ে এখন কোনো মন্তব্য করব না। ধন্যবাদ।’
আরপিওতে যে সংশোধনী এল
বিদ্যমান আরপিও অনুযায়ী, অনিয়ম বা বিরাজমান বিভিন্ন অপকর্মের কারণে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যদি মনে করে তারা আইনানুগ নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না, তাহলে নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে ইসির। সংশোধনীতে এই ক্ষমতা সীমিত করে ইসিকে শুধু ভোটের দিন সংসদীয় আসনের (অনিয়মের কারণে) ভোট বন্ধ করতে পারার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
আরপিওর সংশোধনী অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করে ফেলার পর কোনো আসনের পুরো ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) ভোটকেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর তদন্ত সাপেক্ষে ফলাফল বাতিল করে ওইসব কেন্দ্রে নতুন নির্বাচন দিতে পারবে ইসি।
সংবিধান অনুযায়ী, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন আভাস দিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারি মাসের শুরুতে সংসদ নির্বাচন হবে।
আরপিওর ৯১-এর (ক) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
অবশ্য ইসির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, সংশোধনীতে ইসির ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এত দিন আইনের এই ধারায় অস্পষ্টতা ছিল। এখন কোন কোন ক্ষেত্রে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।
এই ধারার ব্যাখ্যায় নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এত দিন বলে আসছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা পর্যন্ত যেকোনো সময় ইসি ভোট বন্ধ এবং ফলাফল বাতিল করতে পারে।
তবে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই ৯১ (ক) ধারায় অস্পষ্টতা আছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণার পর তা ইসির কাছে পাঠানো হয়। ইসি সচিবালয় গেজেট প্রকাশ করে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণা করার পর গেজেট প্রকাশ না করে ইসি ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে কি না, সেটি পরিষ্কার নয়। এ কারণে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য ইসি এই বিধানের সঙ্গে আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তারা প্রস্তাবে বলেছিল, কোনো অনিয়ম, জোরজবরদস্তি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এলে নির্বাচন কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন করতে পারবে।
তবে ইসিকে পুরো আসনের ফলাফল স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। আইনে বলা হয়েছে, যেসব ভোটকেন্দ্রে (এক বা একাধিক) এসব অভিযোগ থাকবে, ইসি শুধু সেসব কেন্দ্রে ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করে প্রয়োজনে নতুন নির্বাচন করতে পারবে।
সংশোধনীতে আরপিওর ৯১ ধারার (এ) উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘ইলেকশন’ শব্দ দিয়ে পুরো নির্বাচন-প্রক্রিয়া বোঝায়। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়টা হলো ‘ইলেকশন’। আর ‘পোলিং’ হলো শুধু ভোটের দিন। এই সংশোধনী পাস হলে নির্বাচন কমিশন অনিয়মের কারণে শুধু ভোটের দিন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু ‘ইলেকশন’ শব্দটি থাকলে ভোটের আগেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারত। তাই এখানে তাদের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে। তবে আইনে ‘ইলেকশন’ শব্দটির সংজ্ঞাও পরিষ্কার নয়।