কেমিক্যাল মিশ্রিত দূষিত পানির দুর্গন্ধে কেউ নাকেমুখে কাপড় গুঁজে রাখছে কেউবা দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে মুখে মাস্ক পরে চলাচল করছে। কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি দেখলে যে কারও মনে হবে যেন রক্ত ঢেলে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পাড়াগাঁও এলাকার আপন টেক্সটাইলের ডাইংয়ের কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি খালে ফেলার কারণে। কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি ইটিপি ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের খালে ফেলার কারণে দুর্ভোগ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে ২২ গ্রামের প্রায় ২ লাখ বাসিন্দা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, উপজেলা ভুলতা এলাকা থেকে মুড়াপাড়া হয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি খাল রয়েছে। এ খালটির দুইপাশে মর্তুজাবাদ, ভুলতা, পাচাইখা, ভায়েলা, সোনাব, মাছুমাবাদ, পেরাব, হাটাব, আমলাবো, গোলাকান্দাইল, মুড়াপাড়া, ঋষিপাড়া, ত্রিশকাহনীয়া, কালি, আওখাবো, বলাইখাসহ প্রায় ২২ গ্রামের মানুষের বসবাস। এ খালের পানি দিয়ে কৃষকরা কৃষিজমিতে পানি দেওয়া ও সেচ কাজ পরিচালনা করত। এসব গ্রামের মানুষ বেশির ভাগই কৃষি পেশায় নির্ভরশীল ছিল। ভুলতা ইউনিয়নের পাড়াগাঁও এলাকায় আপন টেক্সটাইল নামে কারখানাটি গড়ে ওঠে। এ কারখানা কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার ইটিপি ছাড়াই তাদের ডাইংয়ের বিষাক্ত বর্জ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের খালে ফেলতে শুরু করে। এ কারখানায় ডাইংয়ের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কেমিক্যালের বিষাক্ত গ্যাস এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কেমিক্যালের পানি ফেলার কারণে কৃষকরা সেচ কাজ করার ফলে তাদের ফলন কমতে থাকে। বিষাক্ত এই পানি সেচ বন্ধ করে দেওয়া হলে কৃষিজমিতে ফসল ফলাও বন্ধ হয়ে যায়। এতে কৃষকরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালের গন্ধে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে। কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি পুরো এলাকার পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলেছে। গন্ধে মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, গাছপালাও মরছে। মরে ভেসে উঠছে খামারের মাছ। এ অবস্থায় পুরো এলাকার মানুষ আপন টেক্সটাইলে কেমিক্যালের পানির আতঙ্কে ভুগছেন। এ ছাড়া বিষাক্ত পানি শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে সৃষ্টি করছে ভয়াবহ দূষণ।
রূপগঞ্জ উপজেলায় আপন টেক্সটাইলের মতো আরও অনেক ডাইং কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার বেশির ভাগই ইটিপি প্ল্যান নেই। অবৈধভাবে সরাসরি কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য বিভিন্ন খালে প্রকাশ্য দিবালোকে ফেলা হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জনবহুল এলাকায় আপন টেক্সটাইল কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে। এ কারখানায় সোডা, পারঅক্সাইড, স্টেবিলাইজার, ডিটারজেন্ট, সিকুস্টারিং এজেন্ট, সোপিং এজেন্ট, রিডাকশন, এজেন্ট, এসিটিক অ্যাসিডসহ বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকারক কেমিক্যালের ব্যবহার হয়। এসব কেমিক্যাল জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। স্থানীয়রা বেশ কয়েকবার কারখানা কর্তৃপক্ষকে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি খালে ফেলতে নিষেধ করলেও কোনো কাজ হয়নি। বরং কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের মিথ্যা মামলা ও হামলার ভয় দেখায়।
এদিকে, ভুলতা ইউনিয়ন ৫নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন মিলটি দেখাশোনা করেন। আবুলের ভয়ে কারখানার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। আবুল হাসান জানান, প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তারা কারখানা চালাচ্ছেন।
শিক্ষার্থী সালমা আক্তার জানান, এ খালের পাশ দিয়ে গেলে নাকেমুখে হাত অথবা কাপড় গুঁজে যেতে হয়। পানির দুর্গন্ধে যেন দম বন্ধ হয়ে যায়। খালের পানি রক্তের মতো লাল হয়ে গেছে। শুনেছি আপন টেক্সটাইল এ খালে বিষাক্ত পানি ফেলছে।
কথা হয় কৃষক চান মিয়া, আবেদ আলী, সুলতান মাহমুদ ও আসলাম মিয়ার সঙ্গে। তারা বলেন, ‘বাবাগো কয় বছর আগেও জমিতে ধান লাগাইলে অনেক ফলন পাইতাম। কিন্তু আপন টেক্সটাইলের ডাইয়িং কারখানার কেমিক্যালের পানির কারণে ফলন আর আগের মতন হয় না। তারই লাইগ্যা চাষাবাদ ছাইড়া দিয়া ভ্যান চালাইয়া সংসার চালাইতাছি।’
আরেক কৃষক মোক্তার ভুইয়া জানান, শীতলক্ষ্যার নদীর সঙ্গে এই খালের সরাসরি সংযোগ। আপন টেক্সটাইল কারখানা কর্তৃপক্ষ বিষাক্ত পানি ছাড়ার কারণে খাল নষ্ট হচ্ছে। আর এ খালের পানি নদীতে মিশে শীতলক্ষ্যা নদীকেও দূষিত করছে।
স্থানীয় জেলে শোকলাল বলেন, ‘আগে শীতলক্ষ্যা নদী থেইকা কত্তো রহমের মাছ ধরছি; কিন্তু অহন নদীতে কোনো মাছ নাই। আপন টেক্সটাইলের মতন কিছু কারখানার ময়লা পানি ফেলানোর কারণে নদীর পানি অহন আলকাতরার মতন হইয়া গেছে। তাই নদীতে এখন আর কোনো মাছ পাওন যায় না।’
এ ব্যাপারে আপন টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান মিলন গাজীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
আপন টেক্সটাইল দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ভুলতা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন বলেন, আমরা ইটিপি ব্যবহার করেই খালে পানি ফেলি। তবে মাঝেমধ্যে ইটিপি বন্ধ থাকলে বর্জ্যসহ পানি ফেলা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আইভী ফেরদৌস বলেন, কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং এটি মানবদেহের হুমকিস্বরূপ। কেমিক্যালে মিশ্রিত পানির সংস্পর্শে গেলে চর্মরোগ, আলসার, ক্যানসারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগ মরণব্যাধি হতে পারে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যেহেতু আপনার মাধ্যমে জেনেছি বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা