বায়ুদূষণের ফলে রূপগঞ্জ এখন হুমকির মুখে। ফলে রূপগঞ্জকে বাঁচানোর পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন পরিবেশবাদী কর্মী ও স্থানীয় সুশীল সমাজের লোকজন। তাদের মতে, জনপ্রতিনিধিরা ভোটের রাজনীতি করেন ঠিকই কিন্তু দূষণের কারণে মানুষের জীবন সংকটাপন্ন। শুধু দূষণের কারণে বছরে রূপগঞ্জে প্রায় ৪৫০ লোকের মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে। এখানেই শেষ নয়, দূষণের কারণে বছরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ শ্বাসকষ্ট রোগে ভোগে। আর রূপগঞ্জে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা। শুধু বায়ুদূষণে ক্ষতি হয় ৪০০ কোটি টাকা। দূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় শিশুরা। রূপগঞ্জের ৫১টি এলাকায় মাটি ও পানিতে সীসার পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ুদূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। রূপগঞ্জের ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।
‘বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে রূপগঞ্জের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। শিল্পকারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে রূপগঞ্জের ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ফেলছে। ফলে পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। খাল ও নদীসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানিও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জের ২৩টি তৈরি পোশাকশিল্পের ওয়াশিং ও ১৪টি ডাইং কারখানার বর্জ্য দূষণের অন্যতম উৎস। এক টন কাপড় উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন। ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে ১ লাখ কোটি লিটার এবং কাগজ কারখানাগুলো থেকে ৪৫ হাজার কোটি লিটার দূষিত বর্জ্য পানিতে মেশে। এ ছাড়া জলাশয় ভরাট, দখল ও দূষণ চলছে। রূপগঞ্জে টিকে থাকা ২৬টি খালের মধ্যে মাত্র দুটি সচল আছে। রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ১৪টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্যমতে, এসব হাসপাতালে শুধু শীত মৌসুমে ৪৫ হাজার শ্বাসকষ্টের রোগী আসে। আর গরম মৌসুমে আরও ১৮ থেকে ১৯ হাজার শ্বাসকষ্টের রোগী আসে। এসব রোগীর মধ্যে কয়েকশ রোগী মারাও যায়।
রূপগঞ্জে পানি ও বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র লোক ও শিশুরা। রূপগঞ্জের ৫১টি এলাকাকে তীব্র মাত্রায় সীসা-আক্রান্ত বা হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকার পানি ও মাটিতে আরও পাওয়া গেছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫), কীটনাশক ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বস্তু। রূপগঞ্জে শুধু সীসা-দূষণের শিকার ৫০ হাজার মানুষ। তাদের বেশিরভাগই শিশু। রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে সীসার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মাত্রার চেয়েও বেশি। রূপগঞ্জ হাসপতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রিফাত তাহের বলেন, ‘পরিবেশ দূষণের প্রধান শিকার নারী ও শিশু। আর অতিরিক্ত সীসা শিশুদের রক্তশূন্যতা সৃষ্টি করে। তারা ঠিকমতো খেলেও অপুষ্টির শিকার হয়।’
মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে বায়ুদূষণের মানমাত্রায় রূপগঞ্জের একিউআই স্কোর ছিল ১৭৮, যা বাতাসের অস্বাস্থ্যকর অবস্থাকে নির্দেশ করে। সাধারণত ১০০ এবং ২০০-এর মধ্যে একিউআই শিশু এবং বয়স্কদের মতো ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ বলে বিবেচিত হয়। ২০১৯ সালের মার্চে পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) বায়ুদূষণের প্রধান ৩টি প্রধান উৎস হিসেবে ইটের ভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া এবং ভবন নির্মাণ প্রকল্পের ধুলাবালির কথা উল্লেখ করা হয়। যার সবকটি রূপগঞ্জে রয়েছে। রূপগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রতিদিন ৪৭ হাজার যানবাহন চলাচল করে।
মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রূপগঞ্জের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা যার ব্যাস সাধারণত ২.৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোটটির (পিএম ২.৫) পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯.৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়। এই মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মান মাত্রার (অর্থাৎ ৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি এবং নির্ধারিত (বার্ষিক) মান মাত্রার চেয়ে ৬ গুণ বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫-এর জন্য নির্ধারিত (বার্ষিক) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। রূপগঞ্জে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ প্রায় ১৪৩টি ইটভাটা। এলাকাভিত্তিক বায়ুর মানের রকমফের থাকলেও সামগ্রিকভাবে রূপগঞ্জের বেশির ভাগ এলাকার বায়ু।’
ভুলতা মেমোরি হাসপাতালের ডা. ফারুক আহম্মেদসহ কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। পরিবেশের প্রধান উপাদান বায়ু, মাটি ও পানি। রূপগঞ্জের বায়ু, মাটি ও পানি তিনটিই দূষিত। বিশেষ করে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। কথাগুলো বলেছেন রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নাজমুল আহম্মেদ। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী, রূপগঞ্জের বায়ু নারী, শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও অসুস্থদের জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’।
পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের উপপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ নানাভাবে দূষিত। অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের পরিবেশকর্মী মাহাবুব আলম প্রিয় বলেন, রূপগঞ্জের রাজনীতিবীদ, সমাজকর্মী, প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে লড়াই করে। ভোট আসলে জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু দূষণের কারণে রূপগঞ্জের মানুষের যে বারোটা বেজে যাচ্ছে, সেদিকে কারও খেয়াল নেই। দূষণ রোধে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আইভি ফেরদৌস বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সেখানে ব্রঙ্কাইটিস ও অ্যাজমার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন ৬০-৭০ জন চিকিৎসা নিতে আসেন।
মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. ইসহাক মিয়া বলেন, বায়ুদূষণে যতগুলো উপকরণ দরকার তার সবগুলোই রূপগঞ্জে রয়েছে। রূপগঞ্জে অপরিকল্পিতভাবে অনেক কল-কারখানা গড়ে উঠেছে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা