আপডেট : ২৬ নভেম্বর, ২০২৩ ১২:৫৪
পিয়ন-বাবুর্চি যখন চিকিৎসক
খোরশেদ আলম, সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী)

পিয়ন-বাবুর্চি যখন চিকিৎসক

গত শুক্রবার ঘড়ির কাঁটায় বিকেল পৌনে ৫টা। সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত একজন রোগী এসেছেন। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন। নাম জুয়েল (২৭), পেশায় তিনি রং মিস্ত্রি। জরুরি বিভাগের ডা. উম্মে হাবিবা প্রমি হাসপাতালে নেই। তিনি পাশের বিল্ডিংয়ের ডক্টরস চেম্বারে প্রাইভেট রোগী দেখছিলেন।

এ সময় গুরুতর আহত জুয়েল চিৎকার করছিলেন ব্যথায়। তার বৃদ্ধ মা কোহিনুর বেগম ডাক্তারের সন্ধানে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলেন।

ডাক্তার না থাকায় জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত পিয়ন ইব্রাহিম ডক্টরস চেম্বারে দৌড়ে গিয়ে চিকিৎসককে রোগী আসার খবর জানান।

এরপর ওই চিকিৎসকের অনুমতিতে পিয়ন নিজেই রোগীর ড্রেসিং শুরু করে দেন। প্রায় ১ ঘণ্টা পর কর্তব্যরত ডাক্তার এসে রোগীকে ভর্তি না করে ব্যবস্থাপত্র ধরিয়ে দেন। পরে রোগীর লোকজনের চাপে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি নেন ওই ডাক্তার।

জানা গেছে, শুধু মাঝেমধ্যে নয়, সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স জরুরি বিভাগে নিয়মিতই ছোটখাটো সেলাই ও ড্রেসিং এসব করছেন পিওন ও বাবুর্চি।

হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী, জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক থাকবেন। শিফট ভাগ করে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগে সহজে ডাক্তার পাওয়া যায় না। কর্ম ঘণ্টায় তাদের পাওয়া যায় আবাসিক কোয়ার্টার ও ডক্টরর্স চেম্বারে। রোগী এলে পিওন অথবা রোগীর স্বজনরা গিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনেন।

এ অবস্থায় জরুরি বিভাগের পিওন ইব্রাহিম, জুয়েল, মোহন, শহিদ ও বাবুর্চি ওয়াহিদুল আলম দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসা দিচ্ছেন রোগীদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পিওন ইব্রাহিমকে কখনো কখনো অফিশিয়াল ফাইল আনা-নেওয়া করতে দেখা যায়। আবার কখনো দেখা যায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিচ্ছে। জরুরি বিভাগে আগত রোগীদের কাটা-ছেঁড়া স্থান সেলাই, ড্রেসিং ও ব্যান্ডেজ করছেন। ডাক্তারের উপস্থিতি ছাড়াই এই বিভাগে প্রতিদিন দু-একজন শিশুর খতনা করান পিওন ইব্রাহিম ও বাবুর্চি ওয়াহিদুল আলম। এতে তাদের বাড়তি রোজগারও হয়।

বাবুর্চি ওয়াহিদুল আলম চাকরিতে যোগদানের পর থেকে এই হাসপাতালেই দায়িত্বরত আছেন। তিনি স্থানীয় হওয়ায় তার দাপটে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতিষ্ঠ। রোগীদের সঙ্গেও তিনি দুর্ব্যবহার করেন। রোগীদের খাবার রান্না, বিতরণের পাশাপাশি জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের পরিবর্তে সেলাই ও ড্রেসিংসহ বিভিন্ন চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।

চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার আবিরপাড়া গ্রামের বৃদ্ধা কোহিনূর বেগম জানান, তার ছেলেকে প্রতিপক্ষরা মারধর করেছে। গুরুতর আহতাবস্থায় হাসপাতালে এলে ডাক্তার না থাকায় পিওন ইব্রাহিম তার ছেলেকে চিকিৎসা দিয়ে ৫০০ টাকা দাবি করেন। তিনি টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালে এক কর্মচারী বলেন, জরুরি বিভাগে পিওন-বাবুর্চি চিকিৎসা দেন এটা সঠিক। চিকিৎসা দিয়ে রোগীর স্বজনদের কাছে টাকা দাবি করেন। টাকা নিয়ে অনেক সময় জরুরি বিভাগের সামনে রোগীর লোকদের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।

উপজেলার চাষিরহাট গ্রামের সাজ্জাদ বলেন, তিনি পেটের ব্যথা নিয়ে তিন দিন এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। তিন দিনই তাকে চিকিৎসা দিয়েছেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা।

জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত পিয়ন ইব্রাহিম বলেন, ‘তিনি পার্শ্ববর্তী উপজেলা বেগমগঞ্জের এক জনপ্রতিনিধির লোক। ডাক্তাররাই তাকে চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ডাক্তারের সামনেই তিনি রোগীদের সার্জিক্যাল কাজ করে থাকেন। রোগীরা খুশি হয়ে টাকা দিলে তিনি নেন।’

এদিকে জরুরি বিভাগে না থাকার বিষয়টি জানতে চাইলে ডা. উম্মে হাবিবা প্রমি বলেন, ‘রোগী না থাকায় তিনি পাশের ভবনে অবস্থান করেছিলেন। তবে জরুরি বিভাগে ডাক্তার থাকেন না, তা সত্য নয়।’

সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইসরাত জাহান বলেন, ‘জরুরি বিভাগে প্রতিনিয়ত চিকিৎসক উপস্থিত থাকেন। কোনো পিয়ন সার্জিক্যাল কাজ করে থাকলে তাদের সতর্ক করা হবে।’

নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’