আপডেট : ২ অক্টোবর, ২০২৩ ১১:০২
নাগরিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত বেতকা-রাখালগাছি চরবাসী
মইনুল হক মৃধা, রাজবাড়ী

নাগরিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত বেতকা-রাখালগাছি চরবাসী

মৌলিক অধিকার বঞ্চিত গোয়ালন্দ উপজেলার দুর্গম চর বেতকা-রাখালগাছির মানুষ। ছবি: দৈনিক বাংলা

‘ম্যায়াডা ৯ মাসের পোয়াতি। এটা দিনের জন্নিও দাক্তার দেহাইবার পারি নাই। তয় আল্লাহ এহন পন্ত ভালোই নাগছে। পোলাপান হওনের কালে কী অইব তা আল্লাই জানে। এই চরে এটা দাক্তার নাই। ওর আব্বায় বাড়ি থাহে না। গাঙে জাল বায়। এটা কিছু (প্রসবকালীন সমস্যা) অইলে আল্লারে ডাহন ছাড়া কিছুই করতে পারুম না। হাসপাতাল তো হেই মেলা দূর, নিবার গেলে ২ থেকে ৩ ঘুণ্টা নাগে। হের পর আবার নাও (নৌকা) না পাইলে তাও নিওন যায় না। কয় দিন আগে আমার বুনির মাইয়া হনুফার পোলাপান হওয়নের সময় মেলা কষ্ট অইছিল। তারে হাসপাতালে নিওনের সময় মইড়া গেল।’ এভাবে কথাগুলো বলছিলেন গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের বেতকা চরের মমেনা বেগম।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দুর্গম চরাঞ্চল বেতকা-রাখালগাছি। প্রায় ৩ ঘণ্টা পদ্মায় ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছাতে হয় ওই চরে। এই চরে অন্তত ৬ হাজার মানুষের বসবাস। এসব মানুষের জীবন যাপনে নেই কোনো মৌলিক অধিকার। তারা বঞ্চিত শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনের নিরাপত্তা থেকে। চরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় এখানে নেই কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক, নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাভাবিক পদচারণা। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকে পড়াশোনার সুযোগ নেই। বরং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন তাদের যাতায়াত ও কর্মস্থলে যথাযথ পাঠদান অনেকটাই কঠিন। কারণ প্রতিজন শিক্ষককে একদিকে যেমন ৩ ঘণ্টা আগে স্কুলের উদ্দেশে রওনা দিতে হয়, আবার ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। এর সাথে প্রতিদিন খরচ করতে হয় ২ থেকে ৩০০ টাকা।

দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে রওনা হয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা পর বেতকা-রাখালগাছি চরে গিয়ে সরেজমিন দেখা যায়, কৃষি কাজ ও মাছ ধরাই এখানকার মানুষের পেশা। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন তারা। এ ছাড়া চরের মানুষ গবাদিপশু পালন করে থাকেন। কিন্তু এ গবাদিপশু বিক্রিযোগ্য হলে ডাকাতদের কবল থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রক্ষা করতে পারেন না তারা। তবে ডাকতদের প্রতিহত করতে তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকে সব সময়। এভাবেই ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা, চোর-ডাকাত ও নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছে তাদের জীবন-জীবিকা।

স্থানীয় কুলসুম বেগম বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে চারটা গরু পালন করেছিলাম। কিছু দিন আগে গরুগুলি বিক্রি যোগ্য হওয়ার পর রাতে ডাকাতরা চারটি গরুই লুট করে নিয়ে গেছে। এই চরবাসীর নিরাপত্তায় এখানে একটি পুলিশ ক্যাম্প করে দিলে আমরা ডাকাতদের হাত থেকে রেহাই পেতাম।’

স্থানীয় চর বেতকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার জানায়, এ বছরের পর তার আর লেখাপড়া করা হবে না। কারণ এই চরে প্রাথমিক শেষ করে মাধ্যমিকে ভর্তির কোনো স্কুল নেই। পড়তে চাইলে রাজবাড়ী অথবা পাবনার কোনো স্কুলে ভর্তি হতে হবে। সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তাই বাবা-মা চেষ্টা করলেও এখানেই তার পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে।

স্থানীয় হাবিজুল শেখ জানান, তারা নানা রকমের সমস্যার মুখোমুখি হয়েই এখানে বসবাস করছেন। বিভিন্ন সময় এখানে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি অফিসাররা আসেন। তারা বিভিন্ন সময় আশ্বাসও দিয়ে যান, কিন্তু কোনোটাই বাস্তবায়ন হয় না। তিনি এই চরের হাজার হাজার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা বিবেচনা করে সরকারের কাছে একটি হাসপাতাল ও একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানান।

চর বেতকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইদ্রিস মোল্লা জানান, যাতায়াত ব্যবস্থাই এই চরের প্রধান সমস্যা। যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ করা গেলে এখানকার হাজার হাজার মানুষের সব রকম নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও জানান, তাদের বিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঝড়ে পড়তে হয়। কারণ এ চরে কোনো মাধ্যমিক স্কুল নেই।

গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মোস্তফা মুন্সী জানান, বেতকা-রাখালগাছি চর গোয়ালন্দে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেখানে বসবাসকারীরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তবে পার্শ্ববর্তী জেলা পাবনার সাথে সড়ক পথে যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হলে চরবাসী এর সুফল পাবেন। দুর্গম ওই চরে একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের ব্যাপরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া জেলা প্রশাসকের কাছে সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের আবেদন করেছি।’

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জাকির হোসেন জানান, ওই চরে একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হয়েছে। সেটি দেখাশুনার জন্য মাঝেমধ্যে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তিনি সেখানে যান। গোয়ালন্দ উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিকের বরাদ্দ পেলে, দুর্গম বেতকা রাখালগাছি চরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থাপন করা হবে।