নাটোরের নলডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র মনিরুজ্জামান মনিরের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন কয়েকজন কাউন্সিলর। নিয়ম না মেনে সাড়ে ৩ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, স্বেচ্ছাচারিতা, কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, ভুয়া প্রকল্পের নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়াসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ মেয়রের বিরুদ্ধে।
এসব বিষয়ে মেয়র বলেছেন, অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা না দেয়ায় একজোট হয়েছেন কাউন্সিলররা। আর অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা।
অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার এবং ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, দুদকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কাউন্সিলররা।
পৌরসভার একাধিক কাউন্সিলরের অভিযোগ, নলডাঙ্গা পৌরসভার সাড়ে ৩ কোটি টাকার গুরুত্বপূর্ণ নগর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দরপত্রের মাধ্যমে পায় নাটোরের মৌসুমি ট্রেডিং। কিন্তু সরকারি বিধি না মেনে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি নাটোর নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে চুক্তিনামা করে পৌরসভার আরও চারজন তালিকাভুক্ত ঠিকাদারকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি কিনে নেন মেয়র মনিরুজ্জামান। সে উন্নয়ন প্রকল্প এখনো চলমান। বিষয়টি মেয়র অস্বীকার করলেও তার কাজের প্রধান অংশীদার রইস উদ্দিন পুরো বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে ঠিকাদার রইস উদ্দিন বলেন, ২০২০ সালে নলডাঙ্গা পৌরসভায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাজ আসে। এ কাজটি তারা পাঁচজন অংশীদার মিলে কিনে নেন। এর মধ্যে একজন অংশীদার বর্তমান মেয়র মনিরুজ্জামান।
এ ছাড়া গ্রামীণ সড়ক সংস্কার, সরকারি জমিতে পাকা ঘর নির্মাণের সুযোগ করে দিয়ে অর্থ আদায়, মুজিব শতবর্ষ পালন, মশক নিধন, সিসি ক্যামেরা কেনা, ভবন রং করে প্রয়োজনের তিন-চার গুণ খরচ দেখিয়ে ভুয়া ভাউচার করে টাকা আত্মসাৎসহ পৌরবাসীর সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ মেয়রের বিরুদ্ধে। ১২ জনের মধ্যে নয়জন কাউন্সিলরই মেয়রের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলেছেন।
পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের ধোবাপুকুর গোরস্থান থেকে তেঁতুলতলা পর্যন্ত ৫ লাখ টাকার গ্রামীণ সড়কের কাজ হয়েছে অথচ আমি জানি না। পৌরসভার রেজুলেশনে প্রকল্পের নাম ও টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হলেও সেখানে কোনো প্রকার কাজ করা হয়নি। মেয়র প্রকল্পের সব টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’
৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মহসিন আলী প্রামাণিক বলেন, ‘কোনে কাজেই কাউন্সিলরদের ডাকা হয় না। সব কাজ করে শুধু বিলে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়।’
৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহবুর রহমান বলেন, ‘গত ২৭ মার্চে স্থানীয় স্কুল মাঠে মুজিব জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কত টাকা খরচ হলো তা মেয়র আমাদের জানাননি। জানতে চাইলেই তার ক্যাডার দিয়ে মারধরের হুমকি দেন। অফিসের মধ্যে সে কারণে রড, হাতুড়ি ও জিআই পাইপ রাখা আছে।’
পৌরসভার কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘সরকারি ক্রয় নীতিমালা-২০০৮ লঙ্ঘন ও কোনো কমিটি ছাড়া সব কেনাকাটা করে পরে মেয়র তাদের দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই মেয়রের রোষানলে পড়তে হয়।’
পৌরসভার ১ নম্বর প্যানেল মেয়র শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়র যা ইচ্ছে তাই করছেন। কোনো কাজেরই পরামর্শ নেয়া হয় না। কোনো মিটিং হলে রেজুলেশন সরবরাহ করেন না। পরে নিজের ইচ্ছেমতো যা খুশি লিখে নেন। এভাবে চলতে পারে না।’
সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মেয়র মনিরুজ্জামান মনির। তিনি বলেন, ‘আসলে কাউন্সিলররা বিভিন্ন সময়ে আমার কাছ থেকে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দাবি করেন। আমি তাদের সেটি দিতে রাজি না হওয়ায় তারা একজোট হয়ে বিভিন্ন দপ্তরে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। এর আগেও তারা দুবার অভিযোগ দিয়েছিলেন।’
মেয়র বলেন, ‘আমি কোনো ধরনের ঠিকাদারির সঙ্গেও জড়িত নই। আমার নিজ নামে কোনো ঠিকাদারি লাইসেন্স নেই। যে সাড়ে ৩ কোটি টাকার অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর এই পৌরসভায় এত টাকা বরাদ্দই হয়নি। আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে এমন অভিযোগ করে বেড়াচ্ছেন।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক নাদিম সারওয়ার বলেন, মেয়রের ঠিকাদারি করার বিষয়ে একটি অভিযোগ এসেছে। আইন অনুযায়ী কোনো মেয়রের ঠিকাদারি কাজ করার সুযোগ নেই। এটি যদি নলডাঙ্গার মেয়র করে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নাদিম সারওয়ার আরও বলেন, ‘শুনেছি, পরিষদ চালাতে গিয়ে কাউন্সিলরদের মতামতকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না মেয়র। এটি করার সুযোগ নেই। কাউন্সিলররা আইনের আলোকেই মেয়রের বিরুদ্ধে রেজুলেশন নিয়ে আসতে পারেন। আইনের ক্ষেত্রে কাউন্সিলরদের সেই ক্ষমতা দেয়া আছে।’ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে অনিয়মের কথা শোনা যাচ্ছে তারও তদন্ত করা হবে বলে জানান নাদিম সারওয়ার।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা