শাহরিয়ার ফিরোজ
বিদায়ী চিত্রনাট্য এমনো হয়! চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
কাঁদছেন ফেদেরার। অঝোরে। শিশুর মতো। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছেন স্ত্রী মিরকা ভাব্রিনেচ। পরিস্থিতি সামাল দিতে তার গালে, কপালে চুমু খেয়ে চলেছেন ভাব্রিনেচ। কিন্তু কান্না থামছে না ফেদেরারের।
সেই কান্না আরও আগেই ছোঁয়াছে হয়ে গেছে লন্ডনের ওটু অ্যারেনায়। ১৭ হাজার ৫০০ দর্শক ধারণক্ষমতার গ্যালারি দর্শকে টইটুম্বুর। কিন্তু তখন সেখানে পিনপতন নীরবতা। সবাই দুঃখভারাক্রান্ত। কেউ চোখ মুচছেন। কেউ বা হারানোর শোকে মুহ্যমান, ভাবলেশহীন!
কোর্টের এক পাশেই ছিলেন পেশাদার সার্কিটে দুই দশকের সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচ। যে ফেদেরারের কাছে হেরে অনেক ট্রফিই খোয়াতে হয়েছে তাদের; কী আশ্চর্য, টেনিস থেকে ফেদেরারের বিদায়ে তাদের চোখেও জল। নাদালের কান্না দেখে তো বোঝার উপায়ই ছিল না, টেনিস থেকে বিদায় তার না ফেদেরারের!
এখানেই ফেদেরার অনন্য, আর সবার চেয়ে আলাদা। এর আগেও ক্রীড়াঙ্গনের অনেক বড় বড় কিংবদন্তি খেলা থেকে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তার বিদায়ে ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বীকেও অঝোরে কাঁদতে কে কবে দেখেছে?
আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ফেদেরার, লেভার কাপেই তিনি ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলবেন। এই ঘোষণার পর হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল টিকিটের দাম। শুরুতে যেখানে ম্যাচের টিকিট ৪০ থেকে ৫১০ পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে, সেখানে পরে হাজার পাউন্ড দিয়েও টিকিট পাননি অনেকেই। টিকিটের এই চাহিদা ফেদেরারকে কোর্টে শেষবারের মতো দেখার জন্য। টেনিস থেকে তার বিদায়লগ্নের সাক্ষী হওয়ার জন্য।
পরশু যারা ওটু অ্যারেনায় যেতে পেরেছেন, নিজেকে ধন্য ভাবতে পারেন এই দৃশ্য দেখে- সব বিদায়ী আনুষ্ঠানিকতার পর ফেদেরারকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন নাদাল-জোকোভিচরা। দলীয় খেলায় সতীর্থরাই কাঁধে তুলে নেয় বিদায়ী খেলোয়াড়কে। ফেদেরার কী ভাগ্যবান! তার বিদায়লগ্নটাকে রাঙাতে কোর্টের প্রতিপক্ষরাও সবাই হাজির।
ফেদেরারের অঝোরে কান্না, মিরকা ভাব্রিনেচের তাকে জড়িয়ে ধরা কিংবা তাকে নাদাল-জোকোভিচের কাঁধে তুলে নেয়ার আগে নাদালকে সঙ্গী করে দ্বৈত ম্যাচ খেলেছেন ফেদেরার। যুক্তরাষ্ট্রের দুই জ্যাক সক -ফান্সিস তিয়াফোর বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটা জিততে পারেননি ফেদেরার। তাতে কী। জয় হার ছাপিয়ে তখন ওটু অ্যারেনায় ‘ফেদেরার’, ‘ফেদেরার’ চিৎকার।
মাইক্রোফোন তাতে তাদের উদ্দেশ্য কিছু বলতে গিয়েই ভেঙে পড়ল ফেদেরারের পেশাদারিত্বের মুখোশ। আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন, তার শেষটায় যেন ‘শেষকৃত্যে’র আবহ তৈরি না হয়। কিন্তু উথলে ওঠা আবেগের সঙ্গে পেরে উঠতে ব্যর্থ ফেদেরার তখন রক্তমাংসের মানুষ। মুখে বলছেন বটে, ‘আমি খুশি। আমি দুঃখিত নই।’ কিন্তু চোখ দিয়ে তখন জল ঝরতে শুরু করেছে। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠেই থেমে থেমে বলে গেলেন, ‘আরও একবার জুতোর ফিতেটা বাঁধলাম। যাই করলাম, সবই শেষবারের মতো। সমর্থক, বন্ধু, পরিবার, সতীর্থদের পাশে পেয়ে দারুণ লাগছে। খুব ভালো একটা ম্যাচ হলো। আমি খুশি।’
কোর্টে ফেদেরারের পরিবারের সবাই ছিলেন এ দিন। বাবা রবার্ট এবং মা লিনেতের উদ্দেশ্য বললেন, ‘আমার বাবা-মাকে ধন্যবাদ। সব সময় তারা পাশে থেকেছেন।’ শুধু পাশেই থাকেননি, আজকের ফেদেরার হতেও তাদের বড় ভূমিকা। ভাবা যায়, ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে টেনিসের ‘ব্যডবয়’ নিক কিরিওসের মতো ফেদেরারও মেজাজ খুইয়ে কোর্টেই র্যাকেট ভাঙতেন, চেয়ার আম্পায়ারের সঙ্গে বাদানুবাদ করতেন। এমনটাও ঘটেছে, ম্যাচ শেষে আম্পায়ারের সঙ্গে করমর্দন না করেই কোর্ট ছেড়ে গেছেন।
তার এই আচরণের ঘোর বড় নিন্দুক ছিলেন তার বাবা-মা-ই। তারাই তাকে বুঝিয়েছেন, ক্ষোভটাকে পারফরম্যান্সে রূপান্তর করতে শিখিয়েছেন। বাবা-মা ছাড়াও ফেদেরারের বদলে যাওয়ার পেছনে মিরকা ভাব্রিনেচেরও বড় ভূমিকা। তিনি স্ত্রী হয়ে আসার পর আর কখনই কোর্টে ফেদেরারকে মেজাজ হারাতে দেখা যায়নি। আর যায়নি বলেই ‘তিনিও র্যাকেট ভাঙতেন’- এটা নতুন প্রজন্মের টেনিস দর্শকের কাছে একটা বড় বিস্ময়। বিদায়ী বক্তব্যে মিরকাকে নিয়েও ফেদেরার বললেন দু’ছত্র, ‘আমার স্ত্রী খুব সমর্থন দিয়েছে। সে আমাকে অনেক, অনেক আগেই থামাতে পারত; কিন্তু সে তা করেনি। সে আমাকে খেলা চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছে।’
এখন ফেদেরারই সবার ‘অনুপ্রেরণা’। গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা সংখ্যায় তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন রাফায়েল নাদাল, নোভাক জোকোভিচ, কিন্তু দর্শক হৃদয়ে ফেদেরার ফেদেরার-ই। অসাধারণ মানুষ ও দুর্দমনীয় প্রতিযোগী-দুয়ের এমনই সুষম মিশেল তিনি ছিলেন যে, তার বিদায়ে টেনিসে একটা শূন্যতা শুধু সাধারণ দর্শকরাই নন, বোধ করছেন কোর্টের প্রতিযোগীরাও। তার সমসাময়িক নাদাল-জোকোভিচ কিংবা নতুন প্রজন্মের স্টেফানোস সিৎসিপাস-ক্যাসপার রুডের ফ্যাকাশে মুখও পরশু বলে দিচ্ছিল তা।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা