দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার (মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি) বেশ খানিকটা বেড়েছে, তবে ডলারের হিসাবে কমেছে। কমেছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে আগামী ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি বা বর্তমান মূল্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ডলারের হিসাবে জিডিপির আকার ৪৬০ দশমিক ২২ বিলিয়ন থেকে ৪৫৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৯৩ ডলার থেকে ২৮ ডলার কমে হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ ডলার।
মঙ্গলবার এই তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। তবে এটি চূড়ান্ত নয়, প্রাথমিক বা সাময়িক হিসাব। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর) তথ্য হিসাব করে এই তথ্য প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয়সহ অন্যান্য সূচক কিছুটা কম-বেশি হয়ে থাকে। বরাবরই এমনটা হয়ে থাকে।
গত ১১ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, প্রাথমিক হিসাবে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। মাথাপিছু আয় কিছুটা কমেছে। তবে কী পরিমাণ কমেছে তা তিনি সে দিন বলেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় মাথাপিছু আয় ও ডলারের হিসাবে জিডিপির আকার কমেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থবছর শেষ হলে দুই-এক মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হবে। প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ৩০ পয়সা ধরে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব প্রকাশ করা হয়েছিল। ডিসেম্বরে সেই ডলারের দাম বেড়ে ৯৭ টাকা ৮১ পয়সা হয়েছিল। সেই দর ধরেই জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়েছে। আর সে কারণেই টাকার অঙ্কে জিডিপির আকার বাড়লেও ডলারের হিসাবে কমেছে।’
গত অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে টাকার হিসাবে জিডিপির আকার ছিল ৩৯ লাখ ৭১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। ডলারের হিসাবে ছিল ৪৬০ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। আর মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৯৩ ডলার।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে অর্থনীতির প্রধান তিন খাতের মধ্যে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ, গত অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে যা ছিল ৩ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ; গত অর্থবছরে হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা সাময়িক হিসাবে ছিল ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, সাময়িক হিসাবে অর্থনীতির প্রধান তিন খাতেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে।
২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তথ্য প্রকাশ করছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। তার আগে ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করা হতো।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে, ২০০৫-০৬ ভিত্তি বছরের হিসাবে যা ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। নতুন হিসাবে তা কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশে নেমে এসেছিল। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ থেকে কমে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে কমে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ হয়।
তবে নতুন হিসাবে প্রতিবছরই মাথাপিছু আয় বেশ খানিকটা করে বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুরোনো হিসাবে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৪ ডলার। নতুন হিসাবে তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩২৬ ডলার। একইভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ২০৯ ডলার হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৫১ ডলার থেকে বেড়ে হয় ২ হাজার ৪৩ ডলার।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ৩১ লাখ ৭০ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৭৮ পয়সা হিসাবে ডলারের হিসাবে ছিল ৩৭৩ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৩২৬ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির আকার বেড়ে হয় ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮১ পয়সা হিসাবে ৪১৬ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৫৯১ ডলার।
করোনাভাইরাস মহামারির আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (ভিত্তি বছর পরিবর্তনের পর ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি। গত এক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল সাড়ে ৬ শতাংশের মতো। আর চার বছরে এই হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে।
তবে ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও তছনছ হয়ে যায়, পাল্টে যায় সব হিসাব-নিকাশ। তার পরও ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আগের বারের (২০১৯-২০) মতো ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বড় লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। কিন্তু করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। মহামারির কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। কোনো কোনো দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরলেও পরে তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে পারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি বলেছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জিত হবে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ বলেছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। সেদিক থেকে চলতি অর্থবছর প্রাথমিক হিসাবে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে ১ শতাংশ পয়েন্টের বেশি।
দেশে মাথাপিছু আয় নিয়ে এক প্রশ্নে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, চলতি মাথাপিছু আয় টাকার হিসাবে বাড়লেও ডলারের হিসাবে কিছুটা কমেছে। তবে কোনো অঙ্ক তিনি বলেননি।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা