আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:৪১
পুতিনকে মোকাবিলায় ব্রিটেনের অযৌক্তিক পরিকল্পনা

পুতিনকে মোকাবিলায় ব্রিটেনের অযৌক্তিক পরিকল্পনা

প্রতীকী ছবি

উইল হাটন

ব্রেক্সিটপন্থিদের হাতে আরও অন্তত দুই বছর আমাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। আমাদের কল্যাণ ও নিরাপত্তাকে তারা হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সেটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস মাত্র এক মাস আগে যে কথা বলেছিলেন, সম্ভবত এখন সেটা ভুলে গেছেন। একসময় তিনি সরকারি আর্থিক সহায়তার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল তার নিজের ও সহযোগীদের রাজনৈতিক স্বার্থে কেবলই একটা কথার কথা। জ্বালানির মূল্যের সর্বোচ্চসীমা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়তো আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেয়ার একটা বিপরীতমুখী পদক্ষেপ, কিন্তু এর একটা অন্ধকার উদ্দেশ্যও ছিল।

অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্টেং যখন স্যার টম স্কোলারকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করেন, তখনই সরকারের উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট হয়ে যায়। স্কোলার আমাদের সেরা ও সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তাদের একজন। কোয়ার্টেংয়ের চিন্তাধারা বোঝা যায় যখন তিনি ব্রিটেনকে ‘একটি স্থবির অর্থনীতি ও দুর্বল প্রবৃদ্ধির দেশ’ করে রাখার জন্য ‘গতানুগতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাবাদের’ ওপর দায় চাপান। কোয়ার্টেং এই ‘বিষাক্ত সংমিশ্রণ’ থেকে আবশ্যিক উত্তরণের জন্য ‘জোরালো পদক্ষেপ’ গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। আর তাতে কর মওকুফ, জনসাধারণের পকেটে অর্থ ফিরিয়ে দেয়া এবং আমাদের ব্যবসা খাতকে করের বোঝা এবং অনুপযোগী নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। কেবল এভাবেই বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিকে বন্ধনমুক্ত করা যেতে পারে বলে সরকার মনে করে। কিন্তু এটা বাজে প্রলাপ এবং মোটেও প্রমাণসিদ্ধ নয়। এ ক্ষেত্রে প্রমাণ ও যুক্তির চাইতে আদর্শিক বিশ্বাস বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। অর্থমন্ত্রীর কথায়, স্কোলার পুরোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাবাদের একজন উদাহরণ। কাজেই তাকে বিদায় নিতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা এখন কতিপয় পরী আর বোকার কাঁধে ভর করে একটা অর্থনৈতিক মেলার কল্পজগতে পথ চলছি। দুই বছরের জন্য জ্বালানির সর্বোচ্চসীমা আড়াই হাজার পাউন্ডে বেঁধে রাখার উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হয়। এটা লাখো মানুষকে উষ্ণতা কিংবা খাবারের মধ্যে একটি বেছে নেয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের হাত থেকে রেহাই দেবে। পাশাপাশি এটা মূল্যস্ফীতির হার চার শতাংশ পর্যন্ত কমাবে এবং ঋণ সেবার খরচ সারা বছরে অন্তত ২ হাজার কোটি পাউন্ড কমাবে, যা আমাদের জাতীয় ঋণের এক-চতুর্থাংশ। এটা বেতন বাড়ার বিপজ্জনক চক্রের ঝুঁকি আংশিক এড়ানোর জন্যও সহায়ক হবে। কিন্তু এসব কারণেই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সর্বোচ্চসীমা নির্ধারণের প্রস্তাব লেবার পার্টি প্রথমেই দিয়েছিল। আর ব্রেক্সিটপন্থিরা কর মওকুফ এবং ন্যূনতম হ্রাসের ব্যাপারে তাদের পছন্দসই অবস্থান রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে বুঝতে পেরে শুধুই ভোল পাল্টেছে। কিন্তু যুদ্ধ আর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় অপরিণামদর্শীদের নিয়ে বিজয়ী হওয়া যায় না। ইউরোপ এখন ইউক্রেন বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কার্যত যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। কারণ, রাশিয়া গ্যাসের দাম বাড়ানোর হুমকি দিয়েই চলেছে। পুতিন সম্প্রতি ভ্লাদিভস্তকে বলে দিয়েছেন যে একটা সময় রাশিয়া আর কিছুই ইউরোপে রপ্তানি করবে না- গ্যাস নয়, তেল নয়, খাবারও নয়। এটা ময়দানের যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াই নয়, বরং অর্থনৈতিক লড়াই। তবু যুদ্ধ তো বটে। এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, ব্রিটেনের জ্বালানি-নীতি বিচক্ষণ নয়। কারণ, এটা মূল বিষয়কে এড়িয়ে যাচ্ছে। যখন দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ বিঘ্নিত হবে বলে আগে থেকেই জানা যাচ্ছে, তখন জ্বালানি-নীতিকে অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদি করতে হবে। এতে ব্যবসা এবং ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকতে হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হতে হবে এবং আকস্মিক অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার মতো বিপর্যয় এড়ানোর বন্দোবস্ত রাখতে হবে। সব বিবেচনাতেই সরকারের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ বিষয়ে সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা মোটেও আর্থিকভাবে টেকসই নয়। ব্রিটেনের জাতীয় ঋণ, ট্রাসের অনুসারীরা যেমন অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছেন, জি সেভেনের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। তাই ধার-দেনা করার সুযোগ রয়েছে। তবে ডলার, ইয়েন ও ইউরো বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রাগুলোর অন্তর্ভুক্ত এবং কানাডা মূল্য পরিশোধের বাড়তি ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। ব্রিটেন যেকোনো বড় বাণিজ্য জোটের বাইরে নিঃসঙ্গ অবস্থায় একটি দুর্বল, ঐতিহ্যবাহী অর্থনীতি। আর আন্তর্জাতিক মূল্য পরিশোধেও ব্রিটেন দীর্ঘমেয়াদে পিছিয়ে রয়েছে। এই অর্থনীতি বিনিয়োগ না বাড়িয়ে জীবনযাপনের মান নিশ্চিত করতে অন্তত ১০ হাজার কোটি পাউন্ডের বাড়তি সরকারি ঋণের বোঝা নিতে পারবে না। কারণ, তাতে ব্রিটিশ মুদ্রার নিশ্চিত অবমূল্যায়ন হবে অথবা সুদের হার বড় আকারে বাড়াতে হবে।

আর্থিক স্থায়িত্ব বা টেকসই অবস্থা বিভিন্ন উপায়ে রক্ষা করার সুযোগ ছিল। জ্বালানি খাতে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার ওপর বড় ধরনের এককালীন কর আরোপ করার সুযোগ ছিল। তা ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ উৎপাদনকেন্দ্রগুলো থেকে সব তেল, গ্যাস সরকারের কাছে অনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক মূল্যের পরিবর্তে নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি বাধ্যতামূলক করা যেত। ভোক্তাদের নিজেদের খরচের রাশ টেনে ধরার পরামর্শ দেয়া যেত। প্রয়োজনে খরচের পরিমাণ নির্ধারিত করে দেয়া যেত এবং মন্ত্রীরা তাতে অগ্রগামী ভূমিকা নিতে পারতেন। উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক বায়ুনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বাড়াতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয়া উচিত। এতে ন্যূনতম সময়ে এবং সর্বনিম্ন খরচে জ্বালানি খাতে সরবরাহ বাড়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে। এ ধরনের প্রতিটি পদক্ষেপ ব্রেক্সিটপন্থিরা অপছন্দ করেন। এভাবে তারা লক্ষ্যহীন, যদিও উদার, সহায়তার প্রস্তাব করে থাকেন। কিন্তু তারা যদি নাগালের আওতাভুক্ত অনিয়ন্ত্রিত খরচের বিষয়গুলো ‍বুঝতে পারেন, ব্যবসায়িক খাতে সহায়তা ছয় মাসে সীমিত রাখার কারণটা ভেবে দেখা দরকার। এখন কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সন্ত্রস্ত হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কোয়ার্টেং প্রস্তাবিত করপোরেশন কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল হতে পারে। আর তাতে বিনিয়োগেও কোনো প্রভাব পড়বে না।

এই শীতে আচমকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কেও সরকার নিশ্চয়ই অবগত আছে। গ্যাস পাইপলাইনে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার এমন আশঙ্কা গত এক দশকে কখনোই দেখা যায়নি। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করাটা সরকারের জন্য নিশ্চয়ই অস্বস্তিকর। ব্রিটেন যখন ইইউর অধীনে একক বাজারব্যবস্থায় ছিল, তখন তারা অন্তত সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের সরবরাহব্যবস্থার (গ্রিডের) সঙ্গে যুক্ত ছিল। একটি বিশেষ চুক্তির আওতায় তারা নরওয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল একক বাজারের ভিত্তিতে আর বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল স্বাধীন, যেহেতু দুই নেটওয়ার্কের মধ্যে চড়াই-উৎরাই ছিল। এখন ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেন অনেকটা আমলাতান্ত্রিক ও ব্যয়বহুল নিলাম ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উদ্বেগজনক সময় পার করছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে এবং আমাদের সরবরাহ ঘাটতির মধ্যে পড়ে গেছি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিবিষয়কমন্ত্রী জেনিফার গ্র্যানহোম চেয়েছেন দেশটির সব তেল পরিশোধনকেন্দ্রগুলো যেন পেট্রল, ডিজেল রপ্তানি করে এবং নিজেদের রিজার্ভ মজবুত করে। রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ওই উদ্যোগ যেন কাকতালীয়ভাবে কোথাও মিলে যায়। আর এটাও আমাদের এখানে সরবরাহের ক্ষেত্রে আরেকটি হুমকি। এসব বাধা আসার আগে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিজেদের গ্যাসের মজুত এমন একটা প্রক্রিয়ায় বাড়াচ্ছিল যাতে আমাদেরও অংশ নেয়া উচিত ছিল। তবে সেটা কেবল গত আগস্টে সম্ভব ছিল যখন ব্রিটিশ জ্বালানি কোম্পানি সেন্ট্রিকা উত্তর সাগরে তাদের অপরিশোধিত গ্যাসকেন্দ্র পুনরায় চালু করার অনুমতি পায়। ধীরে ধীরে তারা সেটাকে ফের সচল করতে পারে। তবে এবারের শীতে সেখান থেকে খুব সামান্যই সহায়তা মিলবে। এভাবেই ব্রেক্সিটপন্থিরা দেশের জ্বালানি সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ছে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের পরিকল্পনা, কর ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ, মজুত তৈরি এবং সহযোগী ইউরোপীয়দের সঙ্গে কর্মসম্পাদন- সবই তাদের অপছন্দ। তারা এমন এক মতাদর্শে বিশ্বাস করে যার কোনো গন্তব্য নেই। কর মওকুফের ‘আর্থিক ঘটনার’ পরিণামে চলতি মাসের শেষের দিকে আমারা জানতে পারব যে, আমাদের জাতীয় ঋণ আরও বাড়বে। আর আমরা অবধারিত লক্ষ্যহীনতার দিকে অগ্রসর হব। সুষ্ঠু ও সৃজনশীল পরিচালনার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি খাতে নিয়ন্ত্রিত বিনিয়োগের পরিণামে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়। এটা এক ধরনের স্বাধীন সম্পর্কের মাধ্যমে আসে, তথাকথিত ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ সৃষ্টিকারীদের মাধ্যমে বা অধিকতর ধনীদের কর মওকুফের মাধ্যমে নয়। গোটা প্রকল্পই মাঠে মারা যাবে। করুণার বিষয় হলো, এটা কনজারভেটিভ পাটির যত ক্ষতিই করুক না কেন, আমাদের বাকিরাও একই বিপর্যয়ের মধ্যে থাকতে বাধ্য হব।

লেখক: ব্রিটিশ কলামিস্ট। ‘দ্য গার্ডিয়া ‘ পত্রিকা থেকে সংগৃহীত।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: আশিস আচার্য