রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেট থেকে নিউ মার্কেটে যাওয়ার ফুটওভারব্রিজ। সেখানে একটি চটের ব্যাগের ওপর ডিজাইনওয়ালা মাস্ক নিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আপনারা তো কেবল বড় ব্যবসায়ীদের কথা লেখেন পত্রিকায়। আমাদের কথা কেউ জানেও না, কেউ বলেও না।’
কিছুটা ক্ষোভ, কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে এই বৃদ্ধ বলেন, ‘বড় ব্যবসায়ীদের পুঁজি অনেক, আপনারা কেবল তাদের জন্যই আহাজারি করেন। অথচ আমরা যারা কোনো রকমে দিন পার করি, তাদের কথা আপনারা জানতেই চান না।’
ক্ষোভ, আক্ষেপ কিছুটা কমে এলে জানালেন তার নাম মো. কাঞ্চন। পাঁচ বছর ধরে এখানেই বসে বিক্রিবাট্টা করেন তিনি। বরিশালের মুলাদী তার বাড়ি। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি সব হারিয়ে ১৫ বছর আগে ঢাকায় এসেছেন। প্রথম দিকে ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করতেন। কিন্তু পুঁজির অভাবে সেই ব্যবসাও হাতছাড়া হয়। এরপর টুকটাক যা কিছু পেতেন, সে নিয়েই বসতেন নিউ মার্কেটের ব্রিজের ওপর।
স্ত্রী, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে মো. কাঞ্চনের সংসার। কিন্তু চারজনের এ সংসারে মাস্ক বিক্রি করে তাদের কারোরই পেট ভরে না। করোনার কারণে দুই বছর ব্যবসা হয়নি। এবার ঈদ সামনে রেখে কিছুটা বিক্রি হবে আশা ছিল। স্ত্রী-ছেলে কিছু না বললেও মেয়েটা একটা নতুন জামার বায়না ধরেছে। আশা ছিল, ঈদের সময় বিক্রি ভালো হলে মেয়ের জন্য একটা নতুন জামা কিনবেন। কিন্তু সেই আশা সব ছাই করে দিয়েছে নিউ সুপার মার্কেটের আগুন।
মো. কাঞ্চন বলেন, শনিবার ভোর ৫টার দিকে আগুনের কথা শোনেন। এরপর নিউ মার্কেট এলাকায় ছুটে আসেন। কিন্তু ইডেন কলেজের পর আর এগোতে পারেননি। পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। এরপর ফের কামরাঙ্গীরচরের বাসায় চলে যান তিনি। সারা দিন বাজারের এক দোকানে টেলিভিশনে আগুনের খবর দেখেছেন, আর অজানা আশঙ্কায় দিন পার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাগো আর ঈদ বলে কিছু রইল না। সরকারি সাহায্য যে এত দেয়, অথচ আমাগো কেউ চেনেই না। কিন্তু আমরা কামরাঙ্গীরচরের ভোটার। সব সাহায্য কই যায়?’
মো. কাঞ্চনের পাশেই মো. খোকন নামে আরেকজন বিক্রেতা সেফটিপিন, বাসন মাজার ঝামাসহ কিছু জিনিস নিয়ে বসেছিলেন। পাঁচ বছর ধরে তিনিও ওই জায়গায়ই বিক্রিবাট্টা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি ঈদের আগে এখানে পা ফেলানোর মতো জায়গা থাকে না। আপনার সঙ্গে কথা বলার ফুরসতও হতো না। কিন্তু আজকে কেউ নাই, আমাগো শেষ করে দিয়া গেছে আগুন।’
খোকনও অভিযোগ করলেন, এখন পর্যন্ত কারও থেকে কোনো সাহায্য তিনি পাননি, কেউ আসেওনি। তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনে কেবল বড় বড় দোকানিগো কান্দন দেখায়, আমরা কেমন আছি, আপনারাও খোঁজ নেন না।’
ফুটওভারব্রিজের ভাঙাচোরা সিঁড়ি পার হয়েই দেখা হয় আখতার মিয়ার সঙ্গে। ৩৫ বছর আগে এখানে ছিলেন তার বাবা, বয়স হওয়ায় বাবাকে বিশ্রামে পাঠিয়ে এখন তিনি গজকাপড়, হিজাব, ওড়না নিয়ে বসেছেন। আখতার মিয়া বলেন, ‘সকাল ৮টার দিকে আরেক ব্যবসায়ীর ফোনে আগুনের খবর পাই। এরপর কোনো রকমে এখানে এসে গোডাউন থেকে কাপড় নিয়ে জান বাঁচাই বাসায় গিয়ে। অন্যান্যবার ঈদের আগেই ওড়না, হিজাব আর গজকাপড় বিক্রির ধুম পইড়া যাইত। কিন্তু এবার সব শেষ।’
আখতার মিয়া বলেন, ‘শবে বরাতের পর থেকে পুরো রমজান মাস, বিশেষ করে ঈদের আগের সাত দিনে বেচাবিক্রি সবচেয়ে বেশি হয়। কিন্তু এবারে সব শেষ। গতবার ছিল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মারামারি, তার আগে ছিল করোনা। ভাবছিলাম এবার হয়তো পুষিয়ে যাবে। কিন্তু পথে বসাইল আগুন।’ তিনি প্রশ্ন করেন, কয়েক দিন আগে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে, এবার লাগল এখানে। এভাবে কেন একের পর এক মার্কেটগুলোতে আগুন লাগছে?
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা