কাইয়ে দু সিনেমা (ফরাসি চলচ্চিত্র সাময়িকী) ঘিরে একদল টগবগে তরুণের বুকের মধ্যে আগুন। আগুন তো নয়, সৃজনশীলতার ফুলকি ছোটে যেন। সেই ফুলকি আটকে থাকেনি ফ্রান্সে। ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। মূল ধারার চলচ্চিত্রকে একেবারে তুলোধুনো করা সমালোচকরা একদিন হয়ে উঠলেন নিজেরাই চলচ্চিত্র নির্মাতা। শুরু হলো ফরাসি চলচ্চিত্রের নতুন যাত্রা। এই তরুণরা নিজেদের নাম দিলেন নুভ্যেল ভেগ বা নবতরঙ্গ। তখন যুদ্ধোত্তর পঞ্চাশের দশক। ফরাসি নবতরঙ্গের সেই টগবগে তরুণদের একজন, যাকে প্রবাদপুরুষ বললে ভুল হয় না। জ্যঁ লুক গদার মারা গেলেন গতকাল। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
১৯৩০ সালের ৩ ডিসেম্বর জন্ম হয় গদারের। চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড পাড়ি জমান। বাবা চিকিৎসক হওয়ার কারণে কৈশোরের একটা বড় সময় কাটে সুইজারল্যান্ডে। সেখানে তার বাবা একটি ক্লিনিক চালাতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফিরে আসেন প্যারিসে।
ইচ্ছা ছিল পড়বেন অ্যানথ্রোপোলজিতে। কিন্তু পড়ালেখাটা আর শেষ করতে পারেননি। আগ্রহী হয়ে ওঠেন অ্যানথ্রোপোলজিতে। যার প্রভাব তার চলচ্চিত্র নির্মাণে দেখা যায়। যা এক সময় ‘সিনেমা ভেরিতে’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৫০ সালে সিনে-ক্লাব দু কুয়ার্তার লাতিন নামে একটি সিনেক্লাবে যোগ দেন। এখানেই দেখা মেলে নবতরঙ্গের আরেক দুই তারকা ক্লদ শ্যাবরল ও ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর সঙ্গে। যারাও হয়ে উঠবেন ফরাসি নবতরঙ্গের জ্বলজ্বলে দুই তারকা। সেখানে চলল দিন-রাত সিনেমা দেখা। এক সাক্ষাৎকারে পরে গদার নিজেই স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ‘সিনেমার পর্দা ছিল আমাদের জন্য এমন একটা দেয়াল, যেখানে জীবন থেকে পালাতে এই দেয়ালের সঙ্গে তুলনা করতাম।’ যদিও তখনো তারা কেবল কাইয়ে দু সিনেমার জন্য চলচ্চিত্র সমালোচনাই করতেন।
সময়টা ১৯৫৪ সাল। প্রথমবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল নির্মাণের। একটা ক্যামেরা ধার করে তৈরি করে ফেলেন ‘অপারেশন বেটন’। এই তো শুরু। এরপর থেকেই নির্মাণের দিকে ঝুঁকলেন গদার। সঙ্গী এই তরুণ দল। কেউ প্রযোজক তো কেউ সহকারী। কিংবা গদারও হয়েছেন কারও কারও সিনেমার সহকারী। এরপর বেশ কয়েক বছর ত্রুফোসহ এই তরুণরা গোটা কয়েক স্বল্পদৈর্ঘ্য নির্মাণ করেন। বলে রাখা ভালো, তখন গদার জার্মান নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখট দিয়ে প্রবলভাবে প্রভাবিত। ব্রেখটের নাট্যরীতি ‘এপিক থিয়েটার’কে তিনি সিনেমায় নিয়ে আসতে চাইলেন। ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হলো এক নতুন ধরনের নির্মাণ পদ্ধতি। খুবই হালকা যন্ত্রপাতি, প্রাকৃতিক আলো, দীর্ঘ শট, কখনো কখনো ইম্প্রোভাইজ সংলাপ, সম্পাদনায় জাম্পকাট, হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা ব্যবহার, এক ধরনের প্রামাণ্যচিত্র ভঙ্গিতে নির্মাণ যেন এত দিনের ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাণ ধারাকে একেবারে উল্টে দিল।
এই করে করে গদার এসে দাঁড়ালেন ষাটের দশকের শুরুতে। এবার বড় ছবি নির্মাণের চিন্তা। সঙ্গী সেই পুরোনো বন্ধু ত্রুফো। প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ‘ব্রেথলেস’ তৈরি করলেন। জিন সেবার্গ আর জঁ পল বেলমেন্দো অভিনেতা। মুক্তির পরে শুধু ফ্রান্সেই নয়, সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিল এই ছবি। শুরু হলো এক নতুন সিনেমা যাত্রা। যাকে বলে গদার পরবর্তী সিনেমা।
এরপরের ইতিহাস সিনেমাপ্রেমী মাত্রই জানা। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ গদার ডজনেরও বেশি ছবি বানান। তবে সবচেয়ে সফল সিনেমা বলা হয় ‘কনটেম্পট’কে। সবচেয়ে ব্যয়বহুলও। গদারের রাজনৈতিক চিন্তা তার ছবিতেই দেখা যায়। ‘দ্য লিটল সোলজার’-এ আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয়টি তুলে ধরেন। তার সিনেমা ‘উইকেন্ড’-এ ভোগবাদি ও বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন। শুধু সিনেমাতেই নয়, রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন রাজপথেও। ১৯৬৮ সালে প্যারিস ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ছাত্র ও শ্রমিকদের আন্দোলন তুঙ্গে। সে সময় সেই আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসব বন্ধ করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গদার। শুধু তাই নয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়েও কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন গদার।
আশির দশক। বয়সও বেড়ে চলে গদারের। সৃজনশীলতায় ভাটা পড়ে। জড়িয়ে যান নানা বিতর্কে। এমনকি তার কাজ নিয়েও চলে সমালোচনা। জীবনের শেষ দিকে একেবারেই লোকান্তর হয়ে যান গদার। নিভৃতে সুইজারল্যান্ডের এক গ্রামে থাকতেন তিনি। ২০১৮ সালে তিনি তার শেষ ছবি আভা গার্দে ঘরানার ছবি ‘দ্য ইমেজ বুক’ নির্মাণ করেন।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা