আপডেট : ২৯ মার্চ, ২০২৩ ১৯:৫৯
বাবাকে ছোঁয়ার ছয় বছরের অপেক্ষা আর ফুরাল না
দৈনিক বাংলা ডেস্ক

বাবাকে ছোঁয়ার ছয় বছরের অপেক্ষা আর ফুরাল না

বাবার ছায়া মাথার ওপর থেকে সরে যাওয়ার বেদনা হয়তো এখনো বুঝতে পারছে না ছয় বছরের আমেনা। ছবি: দৈনিক বাংলা

জন্মের পর বাবাকে দেখেনি আমেনা। সৌদি প্রবাসী বাবা একটি বারের জন্য কোলে তুলে দেননি আদর। কথা ছিল আসছে শনিবার দেশে ফিরবেন বাবা গিয়াস উদ্দিন। তখন আমেনা তার প্রাপ্য সব আদর আদায় করবে সুদে আসলে। সৌদি থেকে হয়তো গিয়াস উদ্দিন আসবেন তার প্রাণহীন নিথর দেহ নিয়ে। কিন্তু আমেনার সেই অপেক্ষা আর কোনদিনও ফুরাবে কি?

কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার গিয়াস উদ্দিন (৫৫) ২০০১ সাল থেকে সৌদি আরব প্রবাসী। ৬ বছর আগে দেশে এসেছিলেন শেষবার। গত সোমবার ওমরাহ করতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩ বাংলাদেশির একজন তিনি ।

ওমরাহ করতে যাওয়ার পথে স্ত্রী রাবেয়ার সাথে মোবাইলে শেষ কথা হয় গিয়াস উদ্দিনের। বলেছিলেন, আগামী ২ এপ্রিল দেশের বাড়িতে ফিরে আসবেন। একসঙ্গে ঈদ করবেন।

তার মৃত্যু সংবাদ বাড়িতে পৌঁছার পর থেকেই চলছে শোকের মাতম। পাগলপ্রায় স্ত্রী রাবেয়ায় বিলাপ থামাতে পারছে না কেউ। গিয়াস উদ্দিনের এক ছেলে ও দুই অবুঝ মেয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে মায়ের আহাজারির দিকে।

একই অবস্থা গাজীপুরের রনির অবুঝ ছেলে, লক্ষ্মীপুরের সবুজ হোসাইনের মা-বাবা, নোয়াখালীর হেলাল ও শহীদুলের স্বজনের। এভাবে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা সইতে পারছেন না তারা।

ইমাম হোসাইন রনির ছেলে দাদার কাছে বার বার জিজ্ঞেস করছিল, ‘আব্বু না বলছিল ভিডিও কলে কাবাঘর দেখাবে। আব্বু কি ভিডিও কল দিছে?’ প্রতিবারই নাতির এ প্রশ্নে হুহু করে কেঁদে উঠছেন রনির বাবা ইমাম আব্দুল লতিফ। একই অবস্থা পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। পুরো পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া, বাকরুদ্ধ এলাকাবাসীও।

রনি (৪০) গাজীপুরের টঙ্গীর বড় দেওড়া এলাকার আব্দুল লতিফের ছেলে। পাঁচ বছর ধরে তিনি সৌদিপ্রবাসী। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে এসেছিলেন। এরপর ২৫ মার্চ আবার কর্মস্থলে ফিরে যান তিনি।

বুধবার সকালে সরেজমিন টঙ্গীর বড় দেওড়া ফকির মার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শোকে স্তব্ধ নিহত রনির পরিবার ও প্রতিবেশীরা। রনির মৃত্যুর খবরে বাড়িতে ছুটে আসছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর সদরে হলেও ফকির মার্কেট এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করেছেন রনির বাবা আব্দুল লতিফ। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রনি দ্বিতীয়।

রনির ভাই হোসেন আলী জসিম জানান, ‘২৫ মার্চ ওমরাহ পালনের জন্য ভাইকে বিমানবন্দর দিয়ে আসি। ওমরাহ পালন শেষে ১ এপ্রিল কাজে যোগদানের কথা ছিল তার।’

ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রনির বাবা আব্দুল লতিফ সরকারের কাছে আকুতি জানান, স্বল্প সময়ে ছেলের লাশটা যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়। রনির অবুঝ শিশুটি এখনো বুঝে উঠতে পারছে না তার বাবা নেই।

সবুজের বাবা হারুন মাছ বিক্রি করে সংসার চালান। একটু সচ্ছলতার আশায় তিন বছর আগে বড় ছেলে সবুজকে চাকরির উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। তার পাঠানো টাকাতেই পরিবার সচ্ছলতার মুখ দেখেছে। শিগগিরই সবুজের দেশে ফেরার কথা ছিল। এর আগে তিনি ওমরাহ করবেন বলেছিলেন। কিন্তু তার আর ওমরাহ করা হলো না। মা-বাবার সঙ্গে শেষ দেখাও হলো না।

সবুজ লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরমোহনা ইউনিয়নের বাবুরহাট এলাকার রাঢ়ী বাড়ির মো. হারুনের বড় ছেলে। তারা চার ভাইবোন। এর মধ্যে সবুজ পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান।

এদিকে নোয়াখালীর শহীদুল এবং হেলালের পরিবার ও স্বজনদের কান্না ও মাতমে ভারী হয়ে উঠেছে গ্রামের বাড়ি।

নিহত মো. হেলাল উদ্দিন (৩৪) চাটখিল উপজেলার নাহারখিল ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম রামনারায়ণপুর গ্রামের ভূঁইয়াজি বাড়ির মৃত মো. হুমায়ুন কবিরের ছেলে এবং মো. শহীদুল ইসলাম শাহেদ (২৭) সেনবাগ উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মোহাম্মদপুর মালেক মোল্লার বাড়ির শরিয়ত উল্লাহর ছেলে।

নিহত হেলালের ছোট ভাই রিপন জানান, এক বছর আগে জীবিকার সন্ধানে বড় ভাই হেলাল উদ্দিন সৌদি আরবে পাড়ি জমান। এরপর তিনি একটি রেস্তোরাঁয় চাকরি নেন। তার হাজাবি নামে তিন বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে।

অন্যদিকে গত বছরের এপ্রিলে পরিবারের বড় ছেলে শহীদুল ইসলাম শাহেদ জীবিকার তাগিদে সৌদি আরব যান। সেখানে তিনি একটি দোকানে কর্মরত ছিলেন। গতকাল ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে কর্মস্থল থেকে রওনা হয়েছিলেন মক্কা নগরীর দিকে। কিন্তু সে যাত্রাই ছিল তার ইহলৌকিক শেষ যাত্রা।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুমিল্লা, গাজীপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী প্রতিনিধি।)