আকবর আলি খানকে প্রথম দেখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে। পছন্দের ইন করা হাফ শার্ট, কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত অবস্থায় দেখে তার সম্পর্কে আমার অনুমান হয়, ‘বাহনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন নির্বিশঙ্কে।’ পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘তিনি হচ্ছেন আকবর আলি খান; ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক, সিএসপি এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেবেন।’
তিনি যখন অর্থসচিবের দায়িত্বে, তখন সচিবালয়ে সামান্য কুশলাদির মধ্যেই সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিল। তখনো তিনি এত বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। মূলত তার খ্যাতি শুরু হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগদানের সময়। এই সময়ে একটা চালু কথা তার সম্পর্কে শোনা গিয়েছিল, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সে সময় ইয়াজউদ্দিনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র রুখে দেয়াতে যে কয়েকজন অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি তার মধ্যে অন্যতম। আবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রতিবাদে সেই সময় তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এ রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের ঘটনা তার জীবনে এটাই প্রথম নয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তাকে পাকিস্তানের সামরিক আদালত তার অনুপস্থিতিতেই ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি দেয়।
তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার ভূমিকাই তার প্রতি আমার গভীর অনুরক্ততা সৃষ্টি করে। আবার তিনি শুধু একজন দক্ষ আমলাই ছিলেন না, ছিলেন একজন অনুসন্ধানী গবেষক এবং লেখক। আমার জানা মতে, তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ১৫টি। তন্মধ্যে ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’, ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ ইত্যাদি গ্রন্থ যেমন পাঠকনন্দিত হয়েছে, আবার গুণেমানেও অতুলনীয়। তার বাংলা রচনাকে কেন্দ্র করে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকাই আখ্যা দিয়েছিল- ‘এই লেখক লিখতে জানেন’।
২.
তিনি মূলত ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে দুটিতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীকালে কানাডার কুইনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং তারই ভাষ্য অনুযায়ী ‘অর্থনীতির বুলি ও দুরধিগম্য পদ্ধতি’ রপ্ত করে অর্থনীতিবিদ হয়ে ওঠেন। তবে তিনি এক ভিন্ন ধাঁচের অর্থনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন, যার কাছে ‘গণিতের বিভীষিকা ও লেখাচিত্রের কণ্টক এড়িয়ে রম্যরচনার অবয়বে অর্থনীতির অপ্রিয় বক্তব্য অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘হালকা ও চটুল ভঙ্গি অর্থনীতির বক্তব্য লঘু করে দেয় না, বরং অনেক ক্ষেত্রে গভীরতর তাৎপর্য বহন করে।’ যাকে কবির ভাষায় বলা যেতে পারে, ‘আমারে পাছে সহজে বোঝ তাইতো এত লীলার ছল, বাহিরে যাহার হাসির ছটা , ভিতরে তাহার চোখের জল’।
৩.
২০১১ সাল। বহিস্থ অবয়বে গুরুগম্ভীর, কিন্তু অর্থনীতি লেখায় নিতান্তই রসিক আকবর আলি খানকে একবার আমি ফোন করেছিলাম । সেই ফোনে অনুরোধ করি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ আয়োজিত ‘Bangladesh at 40 Changes and Challenges’ শীর্ষক সেমিনারে একটা প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য। আমি এখনো অবাক হয়ে যাই, প্রায় নামগোত্রহীন আমার মতো ব্যক্তির অনুরোধে তিনি কীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন এবং ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতেন। অথচ শারীরিক ধকলকে উপেক্ষা করে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে পাঠ করলেন কালজয়ী এক নিবন্ধ- ‘গেল চার দশকের অর্জন আর হতাশার বিবরণ’।
আকবর আলি খানের সেই উপস্থাপিত প্রবন্ধের ভূমিকায় একটা অনবদ্য উদাহরণ শুরুতেই উল্লেখ করেছিলেন। সেটা হলো চীন বিপ্লবের অন্যতম নায়ক চৌ এন লাইকে ফরাসি বিপ্লবের দ্বিশতবার্ষিকীর প্রভাব সম্পর্কে বলতে বলা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- ‘Too soon to tell.’। সেটাকে উদ্ধৃত করে আকবর আলি খান বলেছিলেন, ফরাসি বিপ্লবের মূল্যায়নের জন্য ২০০ বছর যদি যথেষ্ট না হয়ে থাকে, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের বিপ্লব মূল্যায়নে ৪০ বছর (কিংবা ধরুন ৫০ বছর) নিশ্চয় নগণ্য । আবার সেটা ব্যাখ্যা করতে গেলেও তথ্য ঘাটতি, নাটকীয় এবং মর্মান্তিক বাঁকের বিড়ম্বনা আছে, যে প্রবণতাগুলোকে বিগত চার দশকের সংঘর্ষমূলক রাজনীতির উৎস হিসেবে অবিহিত করা যায়। এই কথায় হাসির রোল পড়তে পড়তেই তিনি বলে উঠলেন, ‘একই ঘটনার ব্যাখ্যা নির্ভর করে ব্যাখ্যাকারীর চিন্তারীতির ওপর (Idiosyncrasy of interpreter)।’ উদাহরণস্বরূপ টানলেন লর্ড অচিনলেকের দ্বিতীয় বিবাহের বিতর্ক। সে সময় কেউ কেউ বলেছিলেন, দ্বিতীয় বিবাহটি অচিনলেকের প্রথম স্ত্রীর স্মৃতির প্রতি চরম অবমাননা। আবার কয়েকজন বলে উঠলেন, তিনি যদি দ্বিতীয় বিবাহ না করতেন, তাহলে মনে করা হতো অচিনলেকের প্রথম স্ত্রী বিবাহের প্রতি তাকে খুবই বিরক্ত করে তুলেছিলেন। দ্বিতীয় বিবাহ করে অচিনলেক প্রথম স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সেই পন্থাকে প্রমাণিত করলেন, দ্বিতীয় বিবাহের মাধ্যমে প্রথম স্ত্রীকে বিবাহ করার আনন্দই তিনি ধরে রাখতে চেয়েছেন। অতএব , বাংলাদেশের অগ্রগতি আর অধোগতি নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে।
৪.
প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আকবর আলি খান কী পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘মোল্লা নাসিরউদ্দিন-এর একটি গল্প উল্লেখ করেছিলেন। একবার মোল্লা নাসিরউদ্দিন রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টের নিচে হাঁটু গেড়ে বসে কী যেন খুঁজছিলেন । তার এক প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী হারিয়েছ ‘মোল্লা’? ’আমার চাবি’, মোল্লা বললেন। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর অন্য লোকটি বলল, ‘চাবিটা কোথায় ফেলেছ?’ মোল্লার প্রত্যুত্তর- ‘বাড়িতে।’ তারা বলে উঠল- ‘তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে এখানে খুঁজছ কেন?’ ‘বাড়িতে কোনো আলো নেই। এখানে আলো আছে তাই।’ মোল্লাহ যুক্তি দিলেন।
তিনি মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জার অনুশাসন অনুসরণ করে সেদিন তার রচনায় প্রথমে তথ্যসমৃদ্ধ ঐকমত্যের বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং পরে অবশ্য অধিকতর বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন।
৫.
আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর বিআইডিএস এবং একটি জাতীয় দৈনিকের পক্ষ থেকে আকবর আলি খানকে গুণীজন সংবর্ধনা দেয়ার কথা ছিল। ইতিমধ্যে সে অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রও বণ্টন করা হয়েছে। দৈনিকটি আমার কাছে তার ওপর একটি লেখাও চেয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এসব আয়োজনের আগেই সাচ্চা দেশপ্রেমিক এবং আমার প্রিয় মুখের এই স্পষ্টভাষী জন-অর্থনীতিবিদ সবাইকে শোকে ভারাক্রান্ত করে অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।
আব্দুল বায়েস: সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ ও উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; খণ্ডকালীন শিক্ষক ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা