ফেলুদা সমগ্রর ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ আগেই পড়া ছিল। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে যাওয়ার আগে থেকেই মাথায় ঘুরছিল কাহিনিটা। কিন্তু গ্যাংটকে যাওয়ার সময় নিজেকেও যে গণ্ডগোলে পড়তে হবে তা ভাবনায় ছিল না।
ভারত ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব ছিল সিকিমে যাওয়া। সে অনুযায়ী দার্জিলিং অটোস্ট্যান্ড থেকে গ্যাংটকের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয় চলতি বছরের ৩১ জুলাই। মল রোডের ডলফিন হোটেল ছাড়ার আগে খোঁজ নিতে হলো রাস্তাঘাটের। টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি পথে মাটি ও পাথর ধসের ঘটনা ঘটছে। দার্জিলিংয়ের গোরখাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) এক কর্মকর্তাও পরামর্শ দিলেন ওদিকটায় না যেতে। আর গেলে সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়েই যেতে হবে। তা-ই করতে হলো, কারণ ৪ আগস্ট সিকিমের পাকইয়ং বিমানবন্দর থেকে কলকাতায় যাওয়ার ফ্লাইটের টিকিট কাটা আছে। সিকিম না গেলে প্লেন ভাড়ার টাকাও গচ্ছা যাবে। আর কাছাকাছিই যখন আসা হয়েছে, তখন মেঘের শহর গ্যাংটক না দেখা হলে আফসোস নিয়ে দেশে ফিরতে হবে।
দার্জিলিং থেকে গ্যাংটকের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। পাহাড়ি রাস্তায় শেয়ারড জিপে যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা। বেলা দেড়টার দিকে ছাড়া জিপে পর্যটক মাত্র দুজন। বাকি সবাই ভারতীয়। জিপ ভাড়া ৪৮০ রুপি। সব মিটিয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শুরু হলো পথচলা।
দার্জিলিং ঘোরার সময় ফোনের প্লে-লিস্টে ছিল অঞ্জন দত্ত আর কবীর সুমনের গান। এবার খোঁজ মিলল শ্রীকান্ত আচার্যর গাওয়া ‘মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা/ মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা।’ তবে সে গান পুরোটা শোনা হলো না। পাহাড়ি রাস্তা ধরে জিপ খানিকটা এগোনোর পর দেখা মিলল তিস্তা নদীর। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলের শুকিয়ে যাওয়া তিস্তা নয়। একেবারে খরস্রোতা। উৎপত্তিস্থল থেকে পাহাড় বেয়ে নিচে নামছে, যেন সমতলে যেতে ব্যাকুল!
সমতলে যেতে আমার মনটাও তখন বেপরোয়া। কারণ জিপটা হঠাৎ সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে ওপরের দিকে উঠছে তো আবার তিস্তার কিনার ধরে নিচে নামছে। সঙ্গী স্থানীয় কিছু যাত্রীদের সেদিকটায় কোনো খেয়ালই নেই। যাত্রাবিরতির সময় আবার কাউকে দেখলাম লোকাল মদের বোতল কিনতে। কলকাতা থেকে আসা দুজন সরকারি কর্মকর্তাও গল্পে মশগুল। জিপে বাজানো গানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন তারা। গ্যাংটকে যাওয়ার পথে ফেলুদা আর তোপসে যেমন নির্ভার থাকে ঠিক তেমন। আর আমার অবস্থা তখন জটায়ুর মতো। গ্যাংটকে পৌঁছাতে পারলেই বাঁচি।
জিপের ঝাঁকুনিতে আধো ঘুম থেকে যখন সজাগ হলাম তখন বিকেল চারটা বাজতে আর খানিকটা সময় বাকি। আর কিছুদূর গেলেই সিকিমের র্যাংপো সীমান্ত। সেখান থেকে সিকিমে ঢোকার অনুমতি নিতে হবে। তাই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আগেভাগেই ব্যাগ থেকে বের করতে শুরু করলাম। গণ্ডগোলটা শুরু হলো তখন থেকেই।
পর্যটন মৌসুম না হওয়ায় সীমান্তে থাকা সিকিম পুলিশ খুব বেশি গাড়ি তল্লাশি করছে না। শুধু মুখ দেখেই ছেড়ে দিচ্ছে। আমাদের জিপে পর্যটক দুজন। টিকিট কাটার সময়ই চালককে বলে রাখা ছিল, ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছি, সিকিম বর্ডারে অনুমতি নিতে হবে।’ চালক তখন গাড়ি দাঁড় করাতে সায়ও দিয়েছিলেন। কিন্তু সীমান্তে এসে তিনি ঠিক ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গেলেন। স্থানীয় ভাষায় বললেন, ‘অনুমতি নেয়ার কাজ শেষে ভিন্ন গাড়িতে যেতে হবে। দুজনের জন্য তিনি জিপ দাঁড় করাবেন না।’ এ কথা শুনে মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। ভিন্ন গাড়ি নেয়া মানে পুরো প্রাইভেট কার রিজার্ভ করা। এতে খরচ যা হবে তা দিয়ে গ্যাংটকে দুই রাত থাকা যাবে। আবার অনুমতিপত্র না নিলে হোটেলেও ওঠা যাবে না। দুশ্চিন্তায় যখন পড়ে গেছি তখন চালক বললেন, ‘গ্যাংটকে তার পরিচিত হোটেল আছে। চাইলে দুই রাত সেখানে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। কেউ কিছু বলবে না।’ সহযাত্রী কলকাতার দুই সরকারি কর্মকর্তাও ‘ঠিক দাদা, ঠিক দাদা’ বলে উঠলেন। কিন্তু মনের ভেতর থেকে সংশয় গেল না তাতে। সীমান্ত পেরিয়ে জিপ গ্যাংটকের দিকে যত এগোচ্ছে মনে নানা শঙ্কা তত গাঢ় হচ্ছে।
সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ জিপ পৌঁছাল সিকিম বাস ও অটোস্ট্যান্ডে। বৃষ্টি নেই। দোকানপাটে মানুষ আড্ডায় ব্যস্ত। জিপের ছাদ থেকে ব্যাগ নামানো হচ্ছে। সহযাত্রীরাও যে যার গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিতে প্রস্তুত। এরই মধ্যে যাত্রীর খোঁজে হাজির হয়েছেন শহরের ভেতর চলাচলকারী গাড়ির চালকরা। আমাদের তখন পিছু নিতে হলো জিপের চালকের। তার হোটেল ঠিক করে দেয়ার কথা। কিন্তু এবার তিনি তা না করে অন্যের সাহায্য নিতে বললেন। ভিড় করা চালকরাও গন্তব্য জানতে চাইলেন। কিন্তু অনুমতিপত্র না থাকায় নিতে চাইলেন না কেউ। একজন দেখিয়ে দিলেন অটোস্ট্যান্ডে চালকদের থাকার হোটেল। সেখানে থাকলে কী বিপদ হতে পারে তা ভেবে গায়ে ঘাম ছোটার অবস্থা। ভয় পেলে যে মানুষ আরও ভয় দেখায় আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। কেউ পরামর্শ দিলেন র্যাংপো বর্ডারে ফিরে গিয়ে অনুমতিপত্র আনতে। না হলে ‘অনুপ্রবেশ’-এর অপরাধে পুলিশে খবর দেবে। তাই ফের বর্ডারে যাওয়ার জন্য যখন গাড়ি ঠিক করতে গেলাম তখন চালকরা ভাড়াও চেয়ে বসলেন ইচ্ছেমতো। কেউ বললেন দুই তো কেউ হাঁকলেন তিন হাজার রুপি। এ যেন পুরাই ‘সিন্ডিকেট’। ভয়কে পুঁজি করে ডাকাতির মতো অবস্থা। শেষমেশ দুই হাজার রুপি নিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল র্যাংপোর উদ্দেশে।