শরীফ নাসরুল্লাহ
দুলদুলের গায়ের রং ময়লা। মানে কালো। তাই পরিবার থেকে গান গাওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। রং ফর্সা নয়। গানের গলা দিয়ে যদি ভালো বিয়ে হয়! এই ছিল পরিবারের আশা। সে আশাই যে বাংলা গানের ‘আশা’ হয়ে উঠবে, তা কে জানত!
কলকাতার ঢাকুরিয়ার মেয়েটি তখন কৈশোরে। মনটা পড়ে থাকে কালবৈশাখীর আম কুড়ানো কিংবা বুড়ি ছোঁয়া খেলায়। কখনো কাঁচা মরিচ আর তেঁতুল দিয়ে কাঁঠালের মুচিমাখা আর কাঁচা আম খাওয়া। পারলে দু-তিন ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়া পুকুরে সাঁতার কেটে। বাড়ি ঘেঁষে বেড়িয়ে গেছে ট্রেনলাইন। চাচাতো ভাইবোনদের নিয়ে ট্রেনের সঙ্গে দে ছুট। পরে যখন সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ দেখবেন, তখন অবাক বিস্ময়ে অপু-দুর্গাকে দেখে বলবেন, ‘অপু বা দুর্গা সে তো আমিই।’
কৈশোরের দুরন্ত এই মেয়েটি একদিন সবকিছু ফেলে গান ভালোবেসে ফেলবেন। এমনই যে মৃত্যুশয্যায়ও চোখ মুছবেন গানের সুরে! তার ডাকনাম দুলদুল ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। চিরদিন থাকবেন বাংলা গানের সন্ধ্যা প্রদীপ হয়ে।
সালটা ১৯৩১। আজকের দিন। নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আর হেমপ্রভা দেবীর শেষ সন্তানটি হলো মেয়ে। নাম রাখা হলো সন্ধ্যা। তারা তিন ভাই তিন বোন। এর মধ্যে এক ভাই আর বোন ছোট সময়েই মারা যায়। বাবা ছিলেন ধর্মভিরু। তাই বাবার কণ্ঠে ভাবগম্ভীর ধর্মীয় শ্লোক শোনা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। মা টপ্পা গাইতেন। বড় বোনরা লিখত কবিতা। ভাইবোন, চাচিরা মিলে ঘরের আঙিনায় নতুন শাড়ি টাঙিয়ে করতেন জলসা। সেখানে চলত গান, আবৃত্তি, নাটক। এ রকম পারিবারিক এক সাংস্কৃতিক পরিবেশেই কখন যেন নিজের কণ্ঠেই গান তুলে নিলেন সন্ধ্যা। জলসায় তাই অভিনয়টা করলেও গানটাতেই ছিল মূল আকর্ষণ।
বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে সন্ধ্যা ছুটলেন বাইরের অনুষ্ঠানেও। কিন্তু তখনো সন্ধ্যা জানেন না, গান বলে একটা ব্যাপার আছে, যা শিখতে হয়। বয়স কত আর? থ্রি কি ফোরে পড়েন। কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে যারা গানের প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছিলেন, তারা সন্ধ্যার দুই সহোদর, বড় ভাই রবীন্দ্রনাথ ও মেজো ভাই ধীরেন্দ্রনাথ।
সন্ধ্যা স্মৃতিচারণা করলেন এভাবে, ‘জলসায় নিয়ে গিয়ে শিল্পীদের গান শোনানো- সেও মেজোদারই কাজ। মেজোদাকে একদিন দেখলাম, বেশ চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে। উনি বললেন, তোকে গান শেখালে কেমন হয় তাই ভাবছি। তখন আমি ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি। মেজোদাকে তার ভাবনা ভাবতে দিয়ে হারিকেনের আলোয় পড়ার বই খুলে নিশ্চিন্ত হয়ে পড়তে শুরু করলাম। গান তো শুনলেই শেখা যায়। তার জন্য আবার আলাদা করে শেখানোর যে কোনো ব্যবস্থা থাকতে পারে, আমার মাথায় সে কথা ঢুকল না।’
তারপর সেই মেজো ভাই সন্ধ্যাকে নিয়ে গেলেন সন্তোষ বসুমল্লিকের কাছে। বাড়ির কাছেই থাকতেন তিনি। গানটান গাইতেন। সন্ধ্যার ভাষায়, ‘পড়ার বইয়ের অ-আ-ই-ঈ-এর মতো গানের সা-রে-গা-মা আছে এই প্রথম জানলাম।’ স্কুলপড়ুয়া। তাই গান শেখা অত ভালো লাগল না। তবু সন্তোষ বসুমল্লিকের কাছেই হাতেখড়িটা হয়ে গেল সন্ধ্যার। শিখতেন একটু-আধটু ভজন। খেয়ালের একটা-দুটি বন্দিশ। ওই করে করে প্রথমবার আকাশবাণীতে রেকর্ডিং করে পেয়েছিলেন পাঁচ টাকা। প্রথম রোজগার। বেশ আনন্দ পেয়েছিলেন সন্ধ্যা।
তেরো বছর দশ মাস বয়সে প্রথম গান রেকর্ড করেছিলেন। গিরীন চক্রবর্তীর কথা ও সুরে এইচএমভি থেকে বেরিয়েছিল রেকর্ডটি। এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় শিখছেন, জলসায় গাইছেন। একটু একটু করে গলার ধার বাড়ছে। এর মধ্যে ঘটে গেল এক মজার কাণ্ড। তার মূলেও ওই মেজো ভাই। ’৪৩-৪৪ সালের অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স। সেই সংগীত প্রতিযোগিতায় চুপ করে মেজো ভাই নাম দিয়ে এলেন সন্ধ্যার। বড় ভাই শুনে তো রাগে খুন। তার কথায়, ‘বাচ্চা মেয়ে। গলার আড় ভাঙেনি, তাকে কিনা কম্পিটিশনে নাম দেয়া!’ কিন্তু মেজো ভাইয়ের বোনকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস থামেই না।
সন্ধ্যার অবশ্য এ নিয়ে রা নেই। সন্ধ্যা বলেন, ‘কাকে যে কম্পিটিশন বলে, কম্পিটিশনে কীভাবে গাইতে হয়, কিছুই জানি না। আর জানি না বলেই নার্ভাস হওয়ার কোনোও কারণ নেই। খবরটা বিশেষ গুরুত্ব দিলাম না।’ ১৯৪৩ সালের ৫ ডিসেম্বর। কলকাতার গড়পাড়ের রামমোহন লাইব্রেরি হলে প্রতিযোগিতা হলো। সন্ধ্যা ভজন গাইলেন। তারপর এল ফলাফল। সন্ধ্যা স্মৃতিচারণা করে তার আত্মজীবনী ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’তে লিখেছেন, ‘সেদিন রাত প্রায় দশটা হয়ে গিয়েছে, তবু মেজোদার কোনো পাত্তাই নেই। গান নিয়ে বসতে হলো না। নিশ্চিন্ত হয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমি দিব্যি শোয়ার ব্যবস্থা করছি, এমন সময় চিৎকার করতে করতে মেজোদা বাড়ি এসে ঢুকলেন- ভজনে তুই ফার্স্ট হয়েছিস।…মেজোদা তখন বলছেন, জানিস খবরটা পেয়ে, বুঝলি, আমার এত আনন্দ হয়েছে যে বাসে উঠতে ভুলে গিয়েছি। সেই গড়পাড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে এসেছি।’
এই যে শুরু হলো, তারপরে শুধু গান আর গান। শুধু সন্ধ্যা নয়, হয়ে উঠলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কী করে তিনি গীতশ্রী হয়ে উঠলেন, সেও এক দারুণ গল্প। তিন বছর পর ১৯৪৬ সালের ৬ এপ্রিল। তার বয়স সাড়ে ১৪। ‘গীতশ্রী’ নামের ওই সংগীত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ছোট্ট সন্ধ্যা। সেখানে বিচারক ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ মহম্মদ দাবির খাঁ ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই পরীক্ষায়ও প্রথম হয়েছিলেন তিনি। সন্ধ্যার গাওয়া গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিচারকরা। তাকে ‘গীতশ্রী’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।
এরপর থেকে সন্ধ্যা খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল, রবীন্দ্র, নজরুলসহ একের পর এক আধুনিক গান গেয়েছেন। আর সেই গানে তার জন্য সুরের ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়, অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল মুখোপাধ্যায়, কবির সুমনরা। সন্ধ্যার উত্থান রবীন আর অনুপমের হাতে হলেও জীবনের শেষ দিকে একেবারে অন্য ধরনের সুরে হাজির হয়েছিলেন সন্ধ্যা, সেটা সুমনের কল্যাণে।
বাংলা গানেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন চিরভাস্বর। তবু বোম্বের আঁচ লেগেছিল গায়। শচীন দেববর্মনসহ আরও কয়েকজন নামকরা সংগীত পরিচালকের সুরে গেয়েছিলেন সন্ধ্যা। তখন বন্ধুত্ব হয় আরেক কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে। সন্ধ্যা মুম্বাই গেলে লতার টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল সংবাদমাধ্যমে। তবু তাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। সন্ধ্যার স্মৃতিচারণা, ‘বোম্বেতে আসার কিছুদিন পর লতা একদিন আমাকে এসে বলল, দেখো হিয়াঁ এক পেপারমে লিখা হ্যায়- আব তো সন্ধ্যা মুখার্জি আ গয়ি তো লতা মঙ্গেশকর কেয়া করেগি? জ্বলেগি? লতা আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তুম বলো ম্যায় কেয়া জ্বলুঁ? আমি আর কী বলব। ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। লতাও হাসল। এই ছিল আমাদের সম্পর্ক।’
নানা সুরকার আর ওস্তাদের কাছে গান শিখেছেন সন্ধ্যা। কিন্তু তিনি যার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি আর কেউ নন ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ। তাকে বাবা বলে ডাকতেন। তার মৃত্যুর পরে তার ছেলে মুনাওয়ার খাঁর কাছে শিখতেন।
১৯৫৪ সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের লিপে সন্ধ্যার কণ্ঠে ‘গানে মোর কোন
ইন্দ্রধনু’ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। তারপর থেকে সুচিত্রা-সন্ধ্যা হয়ে উঠল যুগলযাত্রা। সন্ধ্যার কণ্ঠই যেন হয়ে উঠেছিল সুচিত্রার কণ্ঠ! সর্বকালের সেরা প্রেম যেমন পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন সুচিত্রা-উত্তম, তেমনই তাদের প্রেমকে কণ্ঠে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন সন্ধ্যা-হেমন্ত জুটি।
নানা রকমের গান গেয়ে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এই যে এত বড় শিল্পী, তিনি সম্মান পাননি নিজের দেশ থেকে! জীবনের শেষ দিকে পদ্মশ্রী পুরস্কার নিয়ে এক অপমানকর প্রস্তাব এসেছিল তার কাছে। তিনি যদি চান তাহলে তার নাম রাখা হবে এই পুরস্কারের তালিকায়। অথচ তখনো তার সমসাময়িকরা ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন! প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এ পুরস্কারের তার দরকার নেই। দর্শক-শ্রোতারাই তার বড় পুরস্কার। কারণ তারাই তাকে ‘গীতশ্রী’ বানিয়েছেন।
লেখাপড়া আর গানবাজনা দুটি সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছিল তাকে। ক্লাস টেনে বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। তারপর গানেই ডুবে ছিলেন। ‘এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার’, ‘মধুমালতি’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘এই মধুরাত’, ‘চন্দন ও পালঙ্কে’, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’, ‘আমি তার ছলনায়’, ‘তুমি না হয়’, ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’- কতসব জনপ্রিয় গান গেয়েছেন অক্লান্ত। সন্ধ্যার কথায়, ‘এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। বেসিক রেকর্ড করেছি, ছায়াছবিতে গান গেয়েছি, বিভিন্ন কম্পিটিশনে যোগদান করেছি। কনফারেন্সেও গাইছি। ক্লান্তি বলে আমার কিছু নেই। এত উৎসাহ কীভাবে পেতাম জানি না।’
চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুবন ছেড়ে চলে যান সন্ধ্যা। বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। নব্বইয়েও কি ক্লান্তি তাকে ছুঁতে পেরেছিল? ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার শিল্পী হাসপাতালে নার্সদের কাছে অনুরোধ করলেন গান শোনার। কিন্তু তাকে নিতে হবে বিশ্রাম। সন্ধ্যা নাছোড়বান্দা, গান শুনবেনই। অগত্যা মোবাইলে চালানো হলো গান। সন্ধ্যায় কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে ১০৪ নম্বর শয্যা তখন ভেসে যাচ্ছে সুরের ইন্দ্রজালে। কিন্তু আচমকা নার্সরা খেয়াল করলেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের হৃৎস্পন্দন নামতে শুরু করেছে। ‘ম্যাডাম ম্যাডাম’ ডাকেও আর সাড়া মেলেনি। সিপিআর, ভেন্টিলেশন দেয়া হলেও আর চোখ খুললেন না শিল্পী। সেদিন সন্ধ্যায় সন্ধ্যা প্রদীপ নিভে গেল ঠিক, কিন্তু তিনি গানের যে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে গেলেন, তা নিভবে না কোনো দিন।