হারুন আল রশীদ : এইচএমভির পুরো নাম হিজ মাস্টার্স ভয়েস। বুঝিয়ে বলতে গেলে এর লোগোটি এই রকম- একটি গ্রামোফোন প্লেয়ারের মাইক বা হর্নের সামনে মগ্ন হয়ে বসে আছে একটি কুকুর। হয়তো সে গান শুনছে, হয়তো কিছুই শুনছে না। যে কারণে দুনিয়াজুড়ে গানপাগল মানুষের কাছে এইচএমভি একটি পরিচিত নাম। সংগীতের বাজার ধরা বা মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও এই প্রতিষ্ঠানটির কৌশল ছিল এক কথায় অতুলনীয়। যার ওপর ভর করে ভারতীয় উপমহাদেশে তারা রাজত্ব করেছে ৭০ বছরের বেশি সময়।
১৯৭৪ সালের ঘটনা। এইচএমভি সিদ্ধান্ত নিল সেবারের পূজায় কালজয়ী শিল্পী কিশোর কুমার দুটি বাংলা গান গাইবেন। ভাবছেন, এ আর নতুন কী? আছে, নতুন কিছু অবশ্যই আছে। সেই দুটি গানে সুর করবেন আরেক কালজয়ী শিল্পী লতা মঙ্গেশকর। বিস্ময়ের শেষ এখানেই নয়, লতা মঙ্গেশকরও দুটি গান গাইবেন। সেই গান দুটিতে সুর করবেন কিন্তু বাঙালি বাবু কিশোর কুমার। অর্থাৎ দুই শিল্পীর সব মিলে চারটি গান, লিখবেন মুকুল দত্ত। পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণে নড়েচড়ে বসেছেন। ভাবছেন, কোন চারখানা গান? সে কথায় পরে আসছি।
তার আগে বলে রাখি, আজ লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিন। লতার জন্ম ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে ১৯২৯ সালে। হিন্দি প্লেব্যাকের এই সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু হয়েছে এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি, ৯২ বছর বয়সে। মৃত্যুর আগে তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। উপমহাদেশের কোটি কোটি লতা-ভক্ত এখনো তাদের প্রিয় শিল্পীর মহাপ্রয়াণের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আট দশকের বেশি সময় তিনি ভারতীয় সংগীতে এক কথায় এককভাবে রাজত্ব করেছেন। আমাদের আজকের এই লেখাটি মহীয়সী এই নারীর জন্মদিন উপলক্ষে।
এবার আসি পুরোনো কথায়। এইচএমভির কৌশল ছিল, অনুশীলনে বসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিশোর কুমার জানবেন না, পূজায় তার দুটি গানের সুরকার লতা। একই সঙ্গে লতাকেও জানানো হয়নি, তিনি যে দুটি গান গাইবেন সে দুটিতে সুর করবেন কিশোর কুমার।
একদিন সকালে হঠাৎ করে লতা মঙ্গেশকরের ফোন পেলেন গীতিকার মুকুল দত্ত। লতা জানতে চাইলেন, মুকুল বাবু কী করছেন? মুকুল দত্ত জানালেন, শুটিংয়ে যাচ্ছেন। লতা বলেছিলেন, একদিন শুটিংয়ে দেরি করে গেলে মুকুল দত্তের অসুবিধা হবে না। প্রয়োজন পড়লে লতা ছবির প্রযোজককে বলে দেবেন। লতা অনুরোধ করলেন, মুকুল দত্ত যেন গানের খাতা নিয়ে তার বাড়িতে যান।
মুকুল দত্ত লতার বাড়িতে গেলেন। গিয়ে গান পড়ে শোনাতে লাগলেন। অনেক গানের মধ্যে দুটি গান পছন্দ হলো লতার। মুকুল দত্তকে লতা জানান, গানের কথাগুলো তার খুব ভালো লেগেছে। তিনি মুকুল দত্তকে অনুরোধ করেন গান দুটি বাংলায় লিখে দিতে। বললেন, অন্য কাউকে দিয়ে হিন্দিতে অনুবাদ করিয়ে নেবেন। কারণ সুর করতে গেলে গানের কথার গভীরে ঢুকতে হবে।
কিন্তু এইচএমভির অভিনব বিষয়টি কিশোর কুমার জেনে গিয়েছিলেন আগেই। মুকুল দত্ত বাড়ি ফিরতেই তার কাছে এবার ফোন এল কিশোরের। ফোনে বললেন এইচএমভি থেকে বলছে, এবারের পূজায় লতা সুর দেবেন, আমি গাইব। আর আমি সুর দেব, লতা গাইবেন। মুকুল বাবু বললেন, সে খুব ভালো কথা, অসুবিধের কী আছে। কিশোর রসিকতার সুরেই বলেছিলেন, আমার গান লতার গানের চেয়ে ভালো হতে হবে। মুকুল বাবু বললেন, আপনি গাইবেন লতার সুরে, লতা গাইবেন আপনার সুরে। এত ভালো-মন্দ বিচারের সুযোগ আর রইল কই?
এবার আসা যাক বিখ্যাত সেই চারটি গান কী কী। পাঠকেরও নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে বিস্তর কৌতূহল জন্মেছে। কিশোরের গাওয়ার জন্য মুকুল দত্তের লেখা দুটি গান লতা বাছাই করলেন। একটি ‘আমি নেই, ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যায়’, অন্যটি ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’। ‘আমি নেই…’ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের চিত্ত নিশ্চয় এতক্ষণে ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠেছে। এবার বলি, মুকুল বাবু লতা মঙ্গেশকরের জন্য কী লিখলেন। লিখেছিলেন, ‘প্রিয়তম কী লিখি তোমায়’ ও ‘ভালোবাসার আগুন জ্বেলে’।
সন্দেহ নেই, কিশোর কুমারের গাওয়া দুটি গানে অনবদ্য সুর দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। এক কথায় সুর তৈরি করেছেন নিজেকে উজাড় করে। কিশোরের কণ্ঠে তুলে দেয়ার আগে লতা গান দুটি নিজে গেয়েছেন বারবার। এক কথায় গেয়ে গেয়ে গান দুটি কিশোর কুমারকে তুলে দিয়েছিলেন। প্রথম রেকর্ডিং হয়েছিল ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’। কিশোরের দাবি ছিল, এই গান প্রথম গাইলে তার গলা খুলবে। পরে গাইলেন, ‘আমি নেই ভাবতেই…’। ‘আমি নেই’ গানে লতা যেভাবে কিশোরের কণ্ঠের অসাধারণ বেজকে কাজে লাগালেন, তা এক কথায় অতুলনীয়। সম্ভবত এ জন্যই তিনি গান দুটি হিন্দিতে অনুবাদ করিয়েছিলেন।
পরের দিন লতা মঙ্গেশকর গাইলেন কিশোরের সুরে। প্রথম গাইলেন ‘প্রিয়তম কী লিখি তোমায়’। রেকর্ডের উল্টো পিঠে রাগাশ্রয়ী একটি গান ছিল ‘ভালোবাসার আগুন জ্বেলে’। এই দুটি গানও বিপুল সমাদর পেয়েছে। তবে যতটা লতার সুরে কিশোরের গাওয়া গান পেয়েছে, ততটা সম্ভবত নয়।
জন্মদিন উপলক্ষে লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কে অল্প করে আরও একটু বলে রাখি, তিনি বিভিন্ন ভাষায় ৫০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। এর মধ্যে অসংখ্য বাংলা গানও আছে। এত সুর, মায়া আর আবেগ- কজনের কণ্ঠে থাকে। এ কারণেই ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ভূখণ্ডে তার জনপ্রিয়তা অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই কারণেই তিনি ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’।