বাংলা চলচ্চিত্রের সাদাকালো যুগের গুণী অভিনেত্রী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা। নিপুণ অভিনয়ের মাধ্যমে দারুণ দারুণ চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন তিনি। এই অভিনেত্রীর আজ জন্মদিন। কেমন আছেন তিনি? জানতে যোগাযোগ করা হয় গুণী এই অভিনেত্রীর সঙ্গে। নিজের খবর জানানোর পাশাপাশি তিনি দৈনিক বাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন তার সময়ের সিনেমার দিনগুলো নিয়ে।
আজ ১৯ সেপ্টেম্বর। আপনার জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
(হাসি) অনেক ধন্যবাদ। মনে রেখেছেন কীভাবে? আমার তো ১৯৪৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্ম। হিসাব করলে ৭৫ বছর পূর্ণ হলো আজ। এই বয়সে এসেও আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি এটা কিন্তু কম কথা নয়।
জন্মদিনে কি কোনো উৎসবের আয়োজন করা হয়?
এই বয়সে জন্মদিন আরও বেশি করে পালন করা হয়। বয়সটা বাড়ছে। আমি তো মনে করছি আমার বয়সটা কমে যাচ্ছে। এই ৭৫ বছর বয়সে ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হই এটা পালন করতে। এই আয়োজনটা করে আমার নাতি-নাতনিরা। ছেলেমেয়ের ঘর মিলিয়ে ওরা সংখ্যায় ৯ জন। তাদের যে কত রকম আয়োজন! আমার জীবন, আমার অতীত, বর্তমানের নানারকম কথা এমনকি তারা কীভাবে আমাকে দেখেছে, আমাকে বুঝেছে সেসব কাগজে লিখে আমাকে চমকে দেয়। এত চমৎকারভাবে লিখে যেটা দেখে 'আমার মুখে হাসি চোখে পানি এমন অবস্থা'। ওরা ওদের মায়েদের কাছ থেকে আমার জন্মদিন উপলক্ষে নানান রকমের খাবার রান্না, গিফট আর আমার পছন্দের ফুল দিয়ে পুরো বাড়ি সাজিয়ে ফেলে। এ ছাড়াও ওরা নিজেরা আমাকে মুগ্ধ করে ছোটখাটো নাটকে অভিনয় করে দেখায়। সবাই এটা খুব উপভোগ করে। আগের জন্মদিনে থেকে এখনকার জন্মদিনের ভিন্নতা এটিই।
অবসর সময় কীভাবে কাটছে?
অবসর সময় কাটে নানান কাজে। আমি যেহেতু সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন মানুষ। লেখালেখির অভ্যাসও আছে। টুকটাক লেখালেখিও করি। লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশের চিন্তা আছে। শিগগিরই বিস্তারিত জানাব। তা ছাড়া আগে তো অভিনয় করে কত মানুষ হাসিয়েছি, কাঁদিয়েছি, আনন্দ দিয়েছি। এখন নিজের জন্য কিছু করি। একান্ত নিজের জন্য। সেটা হচ্ছে ইবাদত। তারপর নাতি-নাতনি। আর রান্নাবান্নাও আমার খুব পছন্দের কাজ। সব মিলিয়ে সময় কেটে যায়।
আপনাদের সময়ের সিনেমার কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে?
সে সময়ের অনেক স্মৃতি। আমি শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছি। আমাদের সময়কার ছবিগুলোয় হৃদয়ছোঁয়া গল্প, গান, সংলাপ ছিল। আমি যখন বিদেশে যাই তখন বাঙালিরা বলে আপনার এই ছবির এই সংলাপ এই গান এখনো ভুলতে পারি না। তবে আলাদা করে বলব জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া' ছবির গল্প। এই ছবিটি মানুষ এখনো দেখে। তারপর 'মনের মতো বউ', 'নয়নতারা', 'আনোয়ারা', 'অশ্রু দিয়ে লেখা'- এগুলো এখনো খুব মনে পড়ে।
জহির রায়হান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিতুল্য নির্মাতা। তার চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া'র অভিনয়ের সময় কোনো স্মৃতি মনে আছে?
'জীবন থেকে নেয়া' সিনেমা নিয়ে খুব মজার মজার স্মৃতি আছে। শহীদ মিনারে অভিনয়ের সময় আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, রওশন জামিল, শওকত আকবর, রাজ্জাক, বেবি জামান ছিলেন। প্রভাতফেরিতে আমরা দর্শকদের সঙ্গে মিশে অভিনয় করেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল সবাই আমাদের অভিনয়ের লোক। তারপর একটা কথা মনে হলে খুব হাসি পায়। আমরা গাড়ির মধ্যে বসে আছি শট দেয়ার জন্য। হঠাৎ মনে হলো গাড়ি ওপরের দিকে উঠছে। মানে শূন্যে উড়ছে। আমরা ঘাবড়ে গেলাম, গাড়ি ওপরের দিকে কেন উঠছে! তখন আনোয়ার ভাই (আনোয়ার হোসেন) হেসে বলেন, এগুলো কিছু না এগুলো জনপ্রিয়তা। মানুষ এসে গাড়ি ধরে একটু দেখার জন্য। ওপরে উঠিয়ে ফেলছিল।
শোনা যায় আপনার নাম ছিল 'চাটনি'। পরে আপনি 'কাগজের নৌকা' করতে এসে 'সুচন্দা' হয়ে গেলেন।
'চাটনি' নামটা আমার দাদার দেয়া ডাক নাম। দাদা খুব রসিক ও ভোজনবিলাসী লোক ছিলেন। তাই তিনি মজা করে আমার এই নাম দিয়েছিলেন। আমার নাম কোহিনূর আক্তার। তারপর চলচ্চিত্রে গিয়ে নাম হয় 'সুচন্দা। 'কাগজের নৌকা' সিনেমায় নাম আসে নবাগত চিত্রনায়িকা সুচন্দা। সেটা ছিল প্রথম ছবি। আর চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আসা আসার কোনো ভাবনা ছিল না। আমাদের রক্ষণশীল পরিবার। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলাম, সেখান থেকে এক সময় চলচ্চিত্রে আসা। তারপর কাগজের নৌকা করি। তখন সাড়া পেয়েছিলাম অনেক।
আপনারা তিন বোনই অভিনয় করেছেন। নিজেদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল, কে বেশি ভালো করতে পারে সেটা নিয়ে?
আমি অভিনয়ে আসার পর আমি ববিতাকে অভিনয়ে নিয়ে আসি। ববিতাকে অভিনয়ে আনা সহজ ছিল না। পরিবারের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে আনতে হয়েছে। ববিতার পর চম্পাকে নিয়ে আসি। আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল না। তবে সবারই অভিনয়ে ভালো করার প্রবণতা ছিল।
আপনি একটি সিনেমা পরিচালনা করেছেন ‘হাজার বছর ধরে’। এরপর আর পরিচালনায় দেখা যায়নি কেন?
‘হাজার বছর ধরে’- এটা এমন একটা ছবি যেটা আমি ৩ বছর সময় লাগিয়ে করেছি। অনেক পরিশ্রম করেছি। অনেক চিন্তাভাবনা করে সঠিক শিল্পী খুঁজে ছবিটা তৈরি করেছি। এই উপন্যাসটা পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ছবিটা দর্শক খুব পছন্দ করেছে। ছবিটা ৬টি বিভাগে পুরস্কার পায়। তখন মনে হয়েছে কষ্টটা সার্থক।
নতুন প্রজন্মকে কী পরামর্শ দেবেন?
নতুন প্রজন্মকে বলব কাজের দিকে মনোযোগী হতে। অতীতটাকে একটু বুঝে, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালো কিছু গ্রহণ করতে। অভিনয়টা সাধনার বিষয়। সেই সাধনাটা ধরে রাখতে। প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে জায়গাটা আরও চেষ্টা দিয়ে মসৃণ করে তুলতে।