নজরুলসংগীতের অনুষ্ঠান ‘সালাউদ্দিন আহমেদের বৈঠকখানা’-এর শততম পর্ব আয়োজিত হচ্ছে আজ। জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এটি অনুষ্ঠিত হবে বিকেল সাড়ে ৩টায়। নজরুলসংগীত ও আজকের আয়োজন নিয়ে নিজের অনুভূতি জানালেন নজরুলসংগীতশিল্পী সালাউদ্দিন আহমেদ।
আগামীকালের (আজ) আয়োজন নিয়ে বলুন?
আয়োজনটা হচ্ছে সালাউদ্দিন আহমেদের বৈঠকখানা। আমার যত গান, আমাদের যত গান। এই প্রতিপাদ্য নিয়েই যখন করোনা শুরু হলো, প্রচণ্ড ব্যস্ততার সংগীতজীবনে একদম নিস্তব্ধতা নেমে এল। ওই সময় আমরা ভাবলাম, সাংস্কৃতিকভাবে একটি শক্তি যদি মানুষকে দিতে পারি…। তাতে আমরা একটু ব্যস্তও হলাম আবার আমাদের শুদ্ধ সংগীতের যে শক্তি, সেটা দিয়ে তাদের একটু উৎসাহিতও করা হলো। এই ভাবনা থেকে আমরা প্রতি শুক্রবার রাত ৯টায় সালাউদ্দিন আহমেদের বৈঠকখানা আমরা অনলাইনে সরাসরি অনুষ্ঠান শুরু করলাম। খুব সুখের বিষয় হচ্ছে, পুরো পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ এটির সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। তাদের একটা ভালো লাগার জায়গায় পৌঁছাল। আমিসহ মাঝে মাঝেই অতিথি শিল্পীরা এসেছেন। আরেকটি প্রেক্ষাপট হলো, আমার কাছে যারা গান শেখে, তাদের কাছে যে আমি শুদ্ধ সংগীত দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ওই ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণের একটা পাঠ মঞ্চ পরিবেশনা। তালিম নামে একটি সংগঠন শুরু করি। ছেলে-মেয়ে তৈরি করতে হলে তাদের গান গাওয়ার জায়গাটা দিতে হবে। আমি তখন বছর পাঁচ কি সাত আগে শুরু করি। কখনো শিল্পকলার মঞ্চে কিংবা জাদুঘরের মঞ্চে করেছি। এটাও মানুষের অনেক আগ্রহের জায়গায় ছিল। নিজের পকেটের টাকা দিয়েই এটা করি। কখনো স্পন্সরের পেছনে দৌড়াইনি। একটা সময় যেটা হলো যে, পরিবেশ-পরিস্থিতি মিলে একটা বিরতি হয়ে গেল। এরপর করোনা শুরু হলো। তখন আমরা এই অনুষ্ঠানটি শুরু করি। এটা অনেক জনপ্রিয় হয়। এক এক করে শততম পর্বে চলে এল। ভাবলাম যে, ছাত্র-ছাত্রী সবাইকে নিয়ে এটা উদ্যাপন করি।
কারা কারা গাইবেন?
বেশির ভাগই আমার ছাত্র-ছাত্রীরা গাইবেন। তা ছাড়া বাইরের শিল্পীরাও থাকবেন।
এটা তো অনলাইনের আয়োজন ছিল?
মঞ্চে এই প্রথম আমরা শততম পর্ব দিয়ে সালাউদ্দিন আহমেদ বৈঠকখান করতে যাচ্ছি। এখন মাঝে মাঝেই আমরা মঞ্চে এভাবে আয়োজন করব। ছেলে-মেয়েদের অতিথিদের সামনে কেমন করে গাইতে হয়, সেটা শেখাব। তালিমের ব্যাপারটাই এভাবে হবে। গুণীজনের সামনে তারা যেন গান গাওয়ার প্র্যাকটিসটা করতে পারে। এভাবেই পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
শততম পর্ব পর্যন্ত আসতে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন?
আমি সুখী এ জন্য যে, সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছে। চ্যালেঞ্জ ছিল দুই রকম। এমন তো আমাদের গেছে যে, লকডাউনে আমরা কেউ বের হতেই পরিনি। তখন অতিথি শিল্পী আমি সেভাবে আনতে পারিনি। তখন হয়তো পরপর দুটি পর্ব আমি একাই করেছি। অর্থনৈতিক কিছু সমস্যা হয়েছে। এটা অবশ্য সব সময়ই থাকে। তবে এটা কোনো বিষয় ছিল না। আমার উদ্যোগের কাছে সব সমস্যা উড়ে গেছে। তবে একটা শ্রেণির মানুষ আছে, যারা পজিটিভ অ্যাকটিভিটি করতে গেলেও খুঁত, ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে। তারা অনেকেই ভাবতে শুরু করল, সালাউদ্দিন আহমেদের হয়তো এর সঙ্গে অর্থকড়ির কোনো সম্পর্ক আছে। যেহেতু অনলাইনের সঙ্গে একটা অর্থের সম্পর্ক আছে, আমি তা জোর গলায় বলতে চাই। আমি একজন সংস্কৃতিকর্মী, শিল্পী, শিক্ষক। আমার উদ্দেশ্য হলো, আমি যেমন নিজে গান গাই, আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, গত ৩০ বছরে সাস্কৃতিক অঙ্গনে পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে যারা কাজ করেছে, আমি তাদের একজন।
আপনার একটা অন্যতম উদ্দেশ্য নতুন শিল্পী তৈরি করা। নতুন শিল্পীদের মধ্যে নজরুলসংগীতের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
অনেক সম্ভাবনা। এটাই আমার ভালো লাগার জায়গা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। নতুন প্রজন্মকে তৈরি করা আমার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। নিজে গান গাওয়ার পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের তৈরি করা কিন্তু অনেক পরিশ্রমসাধ্য কাজ। এই কাজটি আমি করে যাচ্ছি। সুখের কথা, দেশের বাইরে যেখানেই যাই, যে শহরেই যাই, ফলোয়ার তো আছেই, আমার ছাত্র-ছাত্রীদেরও পাই। আমাদের পরের ও তার পরের প্রজন্মের কথা বলি। আমাদের পরের প্রজন্ম পুরোপুরি গান গাইছে। তার পরের প্রজন্ম জাস্ট সামনে এসেছে। এই দুটি প্রজন্মকেই যদি দেখি, তাহলে দেখব, আমরা অনেক শিল্পী তৈরি করেছি। তারা বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকতা করছে। গান করছে। পুরোপুরি গানকে আশ্রয় করে সামনে চলে আসছে। এটা আমার একটা ভালো লাগার জায়গা।
নজরুলসংগীত শুদ্ধভাবে গাওয়ার যে আন্দোলন, তার কী অবস্থা?
আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের নজরুল ইনস্টিটিউটকে। আমি সেখানে প্রথম স্বরলিপি করার ব্যাপারটার সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। সেটা আজকে প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। এখন অনলাইনে সার্চ করলেই গান পাওয়া যায়। তখন পাওয়া যেত না। ইনস্টিটিউটে সংগৃহীত যে রেকর্ড আমরা আদি রেকর্ড বলি, যেগুলো ১৯৪২ সালের আগে করা। ওই সব রেকর্ড অনুসারে তখন স্বরলিপির কাজ চলছে। ওই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি নিজেকে সম্পৃক্ত করলাম। আমি তখন ১৮তম খণ্ড এবং ২৫তম খণ্ড, যার দুটিই আমার করা স্বরলিপি বই। এখানে কাজ করতে গিয়ে নতুন করে অনুভব করলাম, নজরুলকে নজরুলের মতো করে রাখতে চাই, দেখতে চাই। আমাদের জাতীয় কবি। তার যে সৃষ্টিকর্ম, সেটাকে তার মতো করে প্রতিষ্ঠিত করব। নজরুল নিজেও এটিই চাইতেন। নজরুল যেহেতু অসময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। তার গান নিয়ে অনেক ছেলেখেলা হয়েছে। তারা কথায় কথায় বলে যে, নজরুলের গান একটু এদিক-ওদিক করা যায়। অথচ কোনো দিনই নজরুল এদিক-ওদিক করতে বলেননি। বরং তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত হতেন। এ কথাও বলেছেন, ইদানীং আমার গান প্রায়ই কোনো না কোনো মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। ঘটনাক্রমে আকাশবাণীতে আমি গান শুনলাম। কিছু শিল্পী গান গাইছেন। আমার গান নিয়ে তারা এমন কাণ্ডকারখানা করছে। মনে হচ্ছে যেন আমার গানের রক্তরস সব বেরিয়ে যাবে। তিনি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি বারবার বলেছেন, তার শিল্পকর্ম যেন তার মতোই রাখা হয়। এই কাজটিই আমরা নজরুল ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে করলাম।
প্রযুক্তির উন্নয়নে গানের প্রচারে নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক কোনো প্রভাব পড়ছে?
সালাউদ্দিন আহমেদ বৈঠকখানার আরেকটি ভালো দিক বলি, এই কারোনাকালীন সময় থেকে সারা বিশ্বের অনেক শিল্পী আমার কাছে অনলাইনে গান শেখে। এমনকি কলকাতার অনেক শিল্পী আমার কাছে গান শেখে। তারা ওখানে বলে যে, এই গান সালাউদ্দিন স্যারের কাছ থেকে শিখেছি। তাদেরও আমি বলি, আসুন আমরা নজরুলকে তার মতো করে সবাই মিলে প্রতিষ্ঠিত করি। অনেক খামখেয়ালি হয়েছে, আর খামখেয়ালি না করি।
সর্বস্তরের জনগণের মাঝে নজরুলসংগীতকে ছড়িয়ে দিতে আপনার পরিকল্পনা কী?
অনলাইন প্ল্যাটফর্মটা অনেক শক্তিশালী। এত দ্রুত শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর জন্য আর কোনো মিডিয়া নেই। আমি এটাকে শতভাগ ব্যবহার করতে চাচ্ছি। বিশেষভাবে অনুরোধ বেসরকারি চ্যানেলগুলোর কাছে, তাদের অনেক ভালো ইকুইপমেন্ট আছে। আমরা যদি নজরুলকে তার মতো করে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি, একটু যদি আন্তরিক হই সবাই মিলে। তা হলে নজরুলকে অন্য কলেবরে রেখে যেতে পারব। একটা জিনিস ঘটে, নজরুলের গান নিয়ে অনেকেই মনে করে একটু বেশি কঠিন করে গাইলেই বোধ হয় নজরুলের গান ভালো হয়। অকারণে যেগুলো সহজ গান সেগুলো কঠিন করে গাওয়ার দরকার নেই। তাহলে সাধারণ শ্রোতা তো গান শুনবে না। সুর যদি দুরূহ হয়, তখন আপামর মানুষ সেটা শুনতে চায় না। তারা বিব্রত হয়। এই মেসেজটা ছাত্র-ছাত্রীদের দিই। নজরুলের যেমন দুরূহ গান আছে একটা শ্রেণির জন্য, আবার সাধারণ মানুষের জন্যও তার গান আছে। সবার জন্য যে গান, সেগুলো সাধারণের উপভোগ্য করে পরিবেশন করতে হবে। এটাকে অকারণে কঠিন করে গাইলে মানুষ শুনবে না।
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে কিছু বলার আছে?
আমাদের সমাজের অভিভাবকদের বিশেষ করে আমি অনুরোধ করতে চাই, এখনো কিন্তু সংগীত বা সংগীত শেখার বিরুদ্ধে অবস্থান অনেকেরই আছে। আমি তাদের অনুরোধ করব, আমাদের যে শুদ্ধ সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতির চর্চা সবাই করবেন। অকারণে বিপরীতধর্মী কোনো সংস্কৃতি নিয়ে আপনারা মাতামাতি করবেন না। ছেলে-মেয়েদের যদি আমরা নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করতে পারি, তাহলে তারা বিপথে যাবে না। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাদের সংস্কৃতি শেখান, তাহলে তারা কোনো কূপমণ্ডূকতা, ধর্মান্ধতা, সমাজ পরিপন্থী কোনো কাজ এগুলো করতেই পারে না।