ভারতীয় সিনেমা মানেই বলিউড। এমন ধারণা বলিউডই তৈরি করে রেখেছিল দিনের পর দিন। ভারতীয় সিনেমায় বলিউডের সেই দুর্গে আঘাত হেনেছে ‘বাহুবলী’। আর তাতে চুরমার বোম্বের দাপট। বাহুবলীর পিছু পিছু পুষ্পা, রকি আঘাতের পর আঘাতে কুঁজো করে দিয়েছে মুম্বাইয়ের মায়াবী নগরকে। ভারতজুড়ে এখন দাপট দক্ষিণী সিনেমার। বক্স অফিসে ‘বাহুবলী’, ‘কেজিএফ’, ‘পুষ্পা’, ‘আরআরআর’- এর জয়জয়কার।
তিন খানের মাথায় বজ্রপাত। গত কয়েক বছর ধরে তাদের ঝুলিতে কেবল ফ্লপের হিসাব। আর যাদের তুচ্ছ করে ‘আঞ্চলিক’ ইন্ডাস্ট্রি বলা হতো, তারাই কিনা টানছে বক্স অফিসের জয়রথ। কী আছে ওই ছবি বানানোর রেসিপিতে? একটুখানি কৌতূহল হয় বই কি।
ওদিকে চোখ দিলে যে নামটি সবচেয়ে বেশি নজরে আসে, তা হলো ‘প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা’। ভারতের বহুভাষী আর বহু সংস্কৃতির দেশে এখন সিনেমা হিট করার এই-ই যেন মন্ত্র। প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা বোঝার জন্য চলুন একটা দক্ষিণী ছবির ‘স্টারকাস্ট’ থেকে ঘুরে আসি।
‘সিয়া রা নরসিমা রেড্ডি’ ছবিটি মূলত তেলেগু। তেলেগু মেগাস্টার চিরঞ্জীবী এই ছবির কেন্দ্রীয় অভিনেতা। কিন্তু ছবিতে আছে নানা বৈচিত্র্য। ছবিটি তেলেগুসহ আরও পাঁচটি ভাষায় মুক্তি পায়। ছবিতে অভিনয় করেছেন প্রতিবেশী ইন্ডাস্ট্রির আরও জনাকয়েক তারকা। ছবিতে দেখা গেছে কিচা সুদিপকে, যিনি কন্নড় অভিনেতা। আছেন তামিল তারকা নয়নতারা ও বিজয় সেথুপতি। ভোজপুরি তারকা রবি কিষাণকেও চোখে পড়বে। এমনকি আছেন বলিউড শাহনেশাহ অমিতাভ বচ্চনও।
খুব মোটা দাগে বললে, প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমার রূপটা এমনই। ভারতে সিনেমা এখন আর ‘আঞ্চলিক’ তকমা নিয়ে এক অঞ্চলে পড়ে থাকবে না। সিনেমার ডিজাইনই এমন করা হয়েছে যে, ভাষা, অঞ্চল আর আবেদনে তা হয়ে উঠছে বৈশ্বিক। আর তাই দক্ষিণী এই ‘আঞ্চলিক’ সিনেমাগুলোই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা ভারত, এমনকি ভারতের বাইরেও। বলিউড সেখানে নানান কায়দা-কানুন করে টিকে থাকার চেষ্টায় রত।
শুরুটা কোথায়? এর জন্য ফিরে তাকাতে হবে ২০১৫ সালে। পরিচালক এস এস রাজামৌলী ‘বাহুবলী: দ্য বিগিনিং’ দিয়ে এই ধারণার গোড়াপত্তন করেন। যেখানে তেলেগু ও তামিল তারকাদের মিশেলে তৈরি হয় ছবিটি। প্রথম ছবিই ভারতজুড়ে বক্স অফিসে ঝড় তোলে। পরের পর্ব ‘বাহুবলী: দ্য কনক্লুশন’ ২০১৭ সালে বক্স অফিস চুরমার করে দেয়। শুধু তাই নয়, হিন্দি ছবির তালিকাতেও সর্বোচ্চ আয়কারী ছবি হয়ে দাঁড়ায় ‘বাহুবলী’র হিন্দি ভার্সন। ছবির প্রযোজক শোভু ইয়ারলাগাড্ডা একটা চমৎকার কথা বলেছেন এ প্রসঙ্গে। ‘আমরা যদি আঞ্চলিক কাঁটাতারের বেড়া ভাঙতে পারি যেটি আমাদের একমাত্র বাধা, তাহলে আমরা বাজেটের দিক থেকে হব আরও শক্তিশালী। যে গল্পগুলো আমরা বলতে চাই সেগুলোও বলতে পারব, যে মনোযোগ আমরা পেতে চাই, সেটাও পাব।’
‘বাহুবলী’র পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। ‘প্যান ইন্ডিয়ান ফিল্ম’ এখন প্রায় সব সিনেমাপ্রেমীর কাছেই একটা পরিচিত নাম। এরপর একে একে প্যান ইন্ডিয়ান সিনেমা তৈরি হয়েই চলেছে। ঝড় তুলছে বক্স অফিসে। এমনকি বলিউডের সিনেমা বেনিয়ারাও অস্বীকার করতে পারেননি। তার উদাহরণ মিলল, করণ জোহর প্রযোজিত ‘লাইগার’ ছবিতে। এই ছবির নায়ক তেলেগু তারকা বিজয় দেবরকোন্ডা আর নায়িকা বলিউডের অনন্যা পান্ডে।
এই রেসিপি নিয়ে আবার হাজির সেই রাজামৌলীই। ‘আরআরআর’ ছবিটি তিনি সাজিয়েছেনই তেলেগু আর হিন্দি তারকা দিয়ে। তেলেগু তারকা রাম চরণ আর জুনিয়র এনটিআর এর সঙ্গে বলিউড থেকে নিয়েছেন অজয় দেবগন আর আলিয়া ভাটকে। একই কায়দায় একে একে তৈরি হয়েছে ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’, ‘কেজিএফ: চ্যাপ্টার টু’। ‘কেজিএফ: চ্যাপ্টার টু’-এর দিকেই তাকাই না কেন? কন্নড় এই ছবির নায়ক যশ ও নায়িকা শ্রীনিধি কন্নড় অভিনেত্রী। বলিউড থেকে আছেন সঞ্জয় দত্ত আর রবিনা ট্যান্ডন। তামিল অভিনেতা প্রকাশ রাজ আর তেলেগু অভিনেতা রাও রমেশকে দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এখানেই শেষ নয়, কারিগরি দিকেও আছে বৈচিত্র্য। তেলেগু ছবিরই দেখা গেল সংগীত করা হয়েছে বলিউড সংগীত পরিচালক দিয়ে। কিংবা তামিল ছবিতে আইটেম গানে দেখা গেল বলিউড অভিনেত্রীকে। পরিবেশনায়ও থাকছে যূথবদ্ধ অংশগ্রহণ। ‘বাহুবলী’ হিন্দি ভার্সন পরিবেশন করেছে বলিউডের জাঁদরেল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ধর্ম প্রডাকশন। ‘কেজিএফ’ এর পরিবেশক ছিল ফারহান আখতার ও রিতেশ সিধওয়ানি। ইয়ারলাগাড্ডা ভারতীয় গণমাধ্যমকে জানান, স্থানীয় অংশীদার থাকলে বোঝা যায়, একেক রাজ্যে কীভাবে ছবিটি পরিবেশন করতে হবে। কারণ একটা ছবি বক্স অফিসে সফল করতে ওই অঞ্চলের দর্শকই আসল কথা। প্রত্যেক ইন্ডাস্ট্রির দর্শকের সঙ্গে ছবি দিয়ে যোগাযোগের জন্য আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে।
এ ছাড়া গল্প ও উপস্থাপনায়ও এই ছবিগুলো আলাদা। বলিউডের এক সময়কার ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ অ্যান্টি হিরো ধারণাকেই যেন ফিরিয়ে এনেছে এগুলো। হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকাতে ফিল্ম বিশেষজ্ঞ অভিমন্যু মাথুরের কথায়, হিন্দি ছবিতে আগে যে বিষয়টি ছিল সেটিই তারা আত্মস্থ করেছে। সত্তর-আশির দশকে অমিতাভ বচ্চনরা যে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ অ্যান্টি হিরো চরিত্রগুলো করেছেন সেগুলোই অন্যভাবে উঠে আসছে দক্ষিণী ছবিতে। উদাহরণ দিয়ে তিনি ‘দিওয়ার’, ‘ডন’, ‘শক্তি’ ও ‘অগ্নিপথ’ ছবিগুলোর কথা বলেন।
ফিল্ম ট্রেড অ্যানালিস্ট অতুল মোহন মনে করেন, দেখতে বলিউডে চরিত্রের অ্যান্টি হিরোদের মতো মনে হলেও দক্ষিণী ছবির চরিত্রগুলোর আবেদন বৈশ্বিক। তিনি বলেন, “আপনি যদি ‘পুষ্পা’র দিকে তাকান, একটা অর্থে প্লট ও থিমের দিক থেকে ‘দিওয়ার’ কিংবা মি. বচ্চনের সত্তর ও আশির দশকের ছবিগুলোর সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে, ‘কেজিএফও’ তাই।… কিন্তু আসলে এটা একটি বৈশ্বিক আইডিয়া।”
তবে মোটকথা হলো, হিরো-এন্টি হিরো ফর্মুলার এই ছবি এখন দর্শকের জন্য ‘হটকেক’। ভারতীয় গণমাধ্যম বলিউড হাঙ্গামার কাছে ‘কেজিএফ’ তারকা যশ বলেন, ‘সাধারণ অর্থে এ ধরনের ছবি সারা ভারতবাসী দেখতে চায়। অন্তত যাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তারা এই ধরনের ছবিই পছন্দ করেছেন।’
প্যান ইন্ডিয়ান ফিল্মের এই ধারণা যে শুধু ভারতীয় ছবির আঞ্চলিক বাধা ভেঙে দিচ্ছে তা নয়, পাশাপাশি বক্স অফিসে হলিউডি ছবির জোরও কমিয়ে দিচ্ছে। হলিউড ছবি ভারতীয় বক্স অফিসে ব্যবসার হার বেড়েই চলছে। এই গতি রুখতে ভারতীয় ছবির এক হওয়া ছাড়া আর গতি কী? তেলেগু তারকা বিজয় দেবরকোন্ডার মতে, “এখনই সময় আমাদের ভারতীয় সিনেমা বাজারে এক হয়ে কাজ করার। তা হলেই ‘অ্যাভেঞ্জার্স’-এর থেকেও বড় ছবি বানানো সম্ভব।”