শনিবার, ১১ মে ২০২৪

গরমের বিপদ হিটস্ট্রোক: ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
প্রকাশিত
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
প্রকাশিত : ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ ১৬:৪৬

সারা দেশে প্রচণ্ড দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে, গরম বেড়ে চলছে। দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশেই গরমে হাঁসফাঁস এবং নাভিশ্বাস অবস্থা, আর গরমের উৎপাতে দিশেহারা মানুষ এবং প্রাণীকুল। এ ছাড়া নানা রকম অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই। তবে কয়েক দিনে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

হিটস্ট্রোক কী : গরমের সময়ের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিটস্ট্রোক। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, তাকে হিটস্ট্রোক বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। গরম বাড়লে শরীরও ঘামতে শুরু করে, ঘাম বাষ্পীভূত হলে শরীর ঠাণ্ডা হয় এবং ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায়, খাম বন্ধ হয়ে যায় এবং হিট

স্ট্রোক দেখা দেয়।

হিট স্ট্রোক কাদের বেশি হয় : প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারও হিটস্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন-
১. শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যানসারজনিত রোগে যারা ভোগেন, এমনকি যেকোনো কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, যা হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

২. যারা দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। যেমন কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক।

৩. শরীরে পানিস্বল্পতা হলে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

৪. কিছু কিছু ওষুধ হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণ্নতার ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ ইত্যাদি।

হিটস্ট্রোকের লক্ষণগুলো কী : তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগে অপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক হিট ক্র্যাম্প অথবা হিট এক্সহসশন হতে পারে। হিট ক্র্যাম্পে শরীরের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়, শরীর দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা পায়। এর পরের ধাপে হিট এক্সহসশনে দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস, মাথাব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর অত্যন্ত ঘামতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এর লক্ষণ গুলো হলো-
১. শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।

২. ঘাম বন্ধ হয়ে যায়।

৩. ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে যায়।

৪. নিশ্বাস দ্রুত হয়।

৫. নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।

৬. রক্তচাপ কমে যায়।

৭. খিঁচুনি, মাথা ঝিমঝিম করা, অস্বাভাবিক আচরণ, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্নতা ইত্যাদি।

৮. প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়।

৯. রোগী শকেও চলে যায়। এমনকি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

প্রতিরোধের উপায় কী : গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিটস্ট্রোকের বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়। এগুলো হলো-
১. হালকা, ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। কাপড় সাদা বা হালকা রঙের হতে হবে। সুতি কাপড় হলে ভালো।

২. যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন।

৩. বাইরে যেতে হলে মাথার জন্য চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করুন।

৪. বাইরে যারা কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা মাথায় ছাতা বা মাথা ঢাকার জন্য কাপড়জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে পারেন।

৫. প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন। মনে রাখবেন, গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন-খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে। পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে।

৬. তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয় যেমন- চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত।

৭. রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসব কাজ সম্ভব হলে রাতে বা খুব সকালে করুন। যদি দিনে করতেই হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর রোদ থেকে সরে গিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর লবণযুক্ত পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।

আক্রান্ত হলে কী করণীয় : প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোকের আগে যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই যা করতে পারেন তা হলো-
১. দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যান। যদি সম্ভব হয়, ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন।

২. ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করুন।

৩. প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। চা বা কফি পান করবেন না।

কিন্তু যদি হিটস্ট্রোক হয়েই যায়, তবে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে রোগীর আশপাশে যারা থাকবেন তাদের করণীয় হলো-

৪. রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যান।

৫. তার কাপড় খুলে দিন।

৬. শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করুন। এভাবে তাপমাত্রা কমাতে থাকুন।

৭. সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে ও কুঁচকিতে বরফ দিন।

৮. রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে খাবার স্যালাইন দিন।

৯. দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

১০. সব সময় খেয়াল রাখবেন হিটস্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কি না। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। হিটস্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। এমনকি রোগী মারাও যেতে পারেন। গরমের এই সময়টায় সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে। দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও হাসপাতালে ভর্তি করে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া গেলে বেশির ভাগ রোগীই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

১১. গরমে শিশুদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। বাচ্চাদের বেশি বেশি পানি খাওয়াতে হবে। তারা যেন রোদের মধ্যে অনেক বেশি দৌড়ঝাঁপ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই গরমে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে এর থেকে বেঁচে থাকা উচিত।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


শুভ জন্মদিন

বাংলা ধারাভাষ্যের মহীরুহ চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইসমাইল হোসেন মিলন

আদি ও অকৃত্রিম বাঙালিয়ানায় ভরা একজন মানুষ যখন কমেন্ট্রি বক্সে ভরাট, গম্ভীর, সুললিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, আসসালামু আলাইকুম চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত বলছি। ঠিক তখনই বেতারে কান পাতা আপামর খেলাপ্রেমী বাঙালি আবিষ্ট হয়, যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবন্ত একটি মাঠ… উদ্বেল হয়ে ওঠে গ্রাম থেকে শহর, গলি থেকে রাজপথ (১৯৯৭)। বাংলা ধারাভাষ্যের সেই মহীরুহ হলেন চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।

ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় তার নিখুঁত বাংলা আলংকারিক শব্দচয়ন, ব্যতিক্রমধর্মী কণ্ঠস্বর ইথারে ভেসে শিহরণ জাগায় আপামর বাংলাভাষীকে। ক্রিকেট খেলার সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন মানুষ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় জন্ম বলে এই খেলাটি সরাসরি বা টিভিতে দেখার সুযোগ না হলেও শুধু রেডিওতে যার জাদুকরী কণ্ঠের কিছু কথামালা শুনেই এই ‘ক্রিকেট’ নামক অচেনা খেলাটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম এবং ধারাভাষ্যকার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই জাদুকরী কণ্ঠের মানুষটিই বাংলাদেশ ক্রিকেট অঙ্গনের সবার পরিচিত নাম ও মুখ- চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।

এখনো রেডিও কিংবা টিভির পর্দায় যার জাদুকরী কণ্ঠের ধারাভাষ্যে ক্রিকেটীয় উন্মাদনায় মাতোয়ারা হয় গ্রামগঞ্জ-শহর-বন্দরের লাখ লাখ বাঙালি।

আজ কিংবদন্তিতুল্য এই মানুষটির জন্মদিন। জন্মদিনে প্রিয় মানুষটির প্রতি রইল অফুরন্ত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা। ক্রিকেট পাগল এই জাতিকে আরও দীর্ঘদিন আপনার কণ্ঠের জাদুতে ক্রিকেটীয় উন্মাদনায় মাতিয়ে রাখুন সেই শুভ কামনায়- শুভ জন্মদিন জাফরউল্লাহ শারাফাত।


বঙ্গবন্ধুর ভাবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ। এ দুই মহাপুরুষের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড ছিল বাংলা ও বাঙালির অপরিসীম প্রেম। বাংলা ও বাঙালিকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন একজন সাহিত্য দিয়ে, অন্যজন রাজনীতি দিয়ে। ‘বাঙালি’ বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সে জাতিকেই আবিষ্কার করেন ‘সোনার বাংলায়’। যে বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,’ বঙ্গবন্ধু সেটিকে ভালোবেসে জাতীয় সংগীতে রূপ দেন।

শেখ হাসিনা তার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে অবহিত করেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানায় বই বেশির ভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন; কিন্তু আমার মায়ের অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নাড শয়ের কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল।...মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কি না। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মায়ের সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বই কেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল।...আমার খুবই কষ্ট হয় ওই বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ (শেখ মুজিব আমার পিতা, পৃ: ৭০ ও ৭১)।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তিনি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও তার সহকর্মী মাজহারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, রুশ লেখক আইজ্যাক অ্যাসিমভ, তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত প্রগতিশীল লেখকদের সম্মেলনে যোগদান করেছেন, লাহোরে কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি ‘জাভেদ মঞ্জিল’-এ অবস্থান করেছেন। তার রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে করাচি অভিমুখে যাত্রাকালে তিনি সহযাত্রী কয়েকজন কৌঁসূলিকে কাজী নজরুল ইসলামের কিছু কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাংশ আবৃত্তি করে শোনান। বাংলা ভাষার দিগন্তকে বিস্তৃত করার জন্য বিশ্বকবির অবদানকে বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করতেন। চীনে ভ্রমণকালে তিনি তার উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ২২৮)

স্বদেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি যেমন প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি বৈশ্বিকপর্যায়ে বাংলা ভাষার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব উন্মোচনে তিনি ছিলেন অতি উদ্যমী। ১৯৫২ সালে পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু ও ভারতের ঔপন্যাসিক মনোজ বসু বাংলায় বক্তব্য উপস্থাপন করায় কৌতূহলী অনেক শ্রোতাকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে উত্তর দান করেন তা স্মরণযোগ্য, ‘বাংলা ভাষা যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা এ অনেকেই জানে। ঠাকুর দুনিয়ায় ‘ট্যাগোর’ নামে পরিচিত। যথেষ্ঠ সম্মান দুনিয়ার লোক তাকে করে।...পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ জন লোক এই ভাষায় কথা বলে এবং দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভাষার অন্যতম ভাষা বাংলা।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ: ৪৪)

বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট যে গান বাউল সুরে গীত হয় তা বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শিল্পী জাহিদুর রহিমের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনতে পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাহিদুর রহিম বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রায় নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশ করতেন। বঙ্গবন্ধু ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’, ‘সুপ্রভাত’, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’, ‘দুই বিঘা জমি’ প্রভৃতি কবিতা যেমন আবৃত্তি করতেন, তেমনি গুনগুন করে রবীন্দ্রনাথের গানও গাইতেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

১৯৫৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে বঙ্গবন্ধু কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গানসহ লোকসংগীত পরিবেশিত হয়। ডি এল রায় রচিত ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান হিসেবে অনুষ্ঠানে গীত হয়। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য বঙ্গবন্ধু অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানিদের নিকট ‘সোনার বাংলা’র রূপমাধুর্য ও প্রীতি পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এ গানটি নির্বাচন করেছিলেন।

পাকিস্তানি সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাঙালি পালন করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এতে দেশে অসম্প্রদায়িক আন্দোলনের ধারা গতিশীল হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের ধারা অধিকতর বেগবান হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণার পর। তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ কীভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৬ সালের ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে। এই অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি দিয়ে, গানটির প্রতি ছিল তার আলাদা আবেগ।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়’। প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ দানাবেঁধে ওঠে। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘ক্ষমতাবলে হয়তো সাময়িকভাবে রেডিও ও টেলিভিশন হইতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার বন্ধ করা যাইতে পারে। কিন্তু গণচিত্ত হইতে রবীন্দ্রসংগীতের সুমধুর আবেদনকে কোনোকালেই মুছিয়া ফেলা যাইবে না।’

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হবেই।’ (মুনতাসীর মামুন, পৃ: ২৯৬)

১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ঞধমড়ৎব যধফ ৎবভষবপঃবফ ঃযব যড়ঢ়বং ধহফ ধংঢ়রৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব সরষষরড়হং ড়ভ ইবহমধষরবং ঃযৎড়ঁময যরং ড়িৎশং. ডরঃযড়ঁঃ যরস ঃযব ইবহমধষর খধহমঁধমব ধিং রহপড়সঢ়ষবঃব (ঞযব চধশরংঃধহ ঞরসবং, ১৭.১২.১৯৬৯). রবীন্দ্রসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সমধিক গুরুত্বারোপ করে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে রবীন্দ্র-রচনাবলি প্রকাশের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু জানতেন, একটি জাতির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি দমিত হলে সে জাতি ক্রমান্বয়ে নির্মূল হয়ে পড়ে। তার ভাষায়, ‘একটি জাতিকে পঙ্গু ও পদানত করে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করা।’ তিনি শাহজাদপুরে অবস্থিত রবীন্দ্র কুঠিবাড়ী সংরক্ষণের দাবি উত্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে কলিম শরাফী, জাহিদুর রহিম, আফসারী খানম, বিলকিস নাসির উদ্দীন ও রাখী চক্রবর্তী রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করেন বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ৩০০ ফুট দীর্ঘ এক সুবৃহৎ নৌকার অবয়বে তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নিলেন ৬ দফা বাস্তবায়নই তাদের লক্ষ্য। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা সার্বজনীন। ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিককর্মী ধীরে ধীরে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুতি করছেন। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু শিক্ষার্থীদের জনসভায় রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর ২৩তম বার্ষিকী

উদ্‌যাপিত হয় ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে ঢাকার রমনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান অতিথি। রবীন্দ্র-নজরুলকে পাকিস্তানি শাসকরা বাদ দিতে চাইলে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না; কিন্তু এর ওপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয়, কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে।’

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ভারতীয় দূতাবাসের নির্দেশে কূটনৈতিক অফিসার শশাঙ্ক এস ব্যাণার্জি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। তার স্মৃতিচারণে জানা যায়, বিমানে বসে বঙ্গবন্ধু ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে শুরু করেন। এ সময় তার চোখে জল দেখেন ভারতীয় কূটনৈতিক। গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা উচিত বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মিস্টার ব্যানার্জিকে গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেন। তার ভাবনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন আর নতুন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতও তিনি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন।

১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন। সেদিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’র বিপরীতে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কবিগুরু তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিগুরুর প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের আর কী হতে পারে?

১২ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই জনৈক সাংবাদিক যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কি?’ জবাবে চিরাচরিত হাস্যমুখে তিনি বলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ তিনি ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে রূপ দেন। বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে আমার সোনার বাংলা স্বীকৃতি লাভ করে।

বাংলা একাডেমি আয়োজিত ১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লাখ লাখ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বজাত্যের যে চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছে, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন একাডেমির কর্মকর্তারা। তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালোবাসি তাকে-সাহিত্যে আমার পুঁজি তো ওইটুকুই।’

বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন এ দুজন আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবী। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ এক বিশাল পরিপূর্ণ হৃদয় দিয়ে তিনি মানবকল্যাণের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তার জীবনবোধের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত করে তুলেছেন।

লেখক: পুলিশ সুপার নৌ পুলিশ, সিলেট অঞ্চল

বিষয়:

টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. জাহাঙ্গীর আলম

কৃষির ইংরেজি প্রতিশব্দ এগ্রিকালচার। শব্দটি ল্যাটিন এজারো এবং কালচারা শব্দদ্বয় দিয়ে গঠিত। এর আভিধানিক অর্থ মাটি কর্ষণ। বাংলা শব্দ কৃষি। শব্দার্থ অনুসারে শস্যের চাষ ও বৃক্ষরোপণ সরাসরিভাবে কৃষিকর্মের অন্তর্ভুক্ত। এর সঙ্গে পশুপাখি পালন ও মৎস্য চাষও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব, কৃষি খাত বলতে আমরা শস্য, মৎস্য, বন ও পশুপাখি উপখাতসমূহকে সমন্বিতভাবে বুঝে থাকি। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১২ শতাংশ। মোট রপ্তানিতে কৃষিজাত পণ্যের শরিকানা প্রায় ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে হিমায়িত মৎস্য ও পাটজাত দ্রব্য যোগ করা হলে মোট রপ্তানিতে কৃষির হিস্যা প্রায় ৭ শতাংশে বৃদ্ধি পায়। এখনো দেশের শতকরা ৪০ ভাগ শ্রমিক কৃষিখাতে নিয়োজিত। শিল্প ও সেবাখাতের অগ্রগতিও বহুলাংশে নির্ভরশীল কৃষিখাতের অগ্রগতির ওপর। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কৃষিখাতের উন্নয়ন একান্তভাবে প্রয়োজন।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন খাতে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হলো কৃষি খাত। অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে খাদ্য আমদানি করা হতো ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। বর্তমানে সে ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৫ শতাংশেরও নিচে। স্বাধীনতার পর দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখ টনের ওপরে। গত ৫২ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। যে কৃষকের আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল সে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল দৈনিক ৩ কেজি চালের সমান মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক, কী শ্রমিক-কারোরই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই। কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, গম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। আলু, মৎস্য, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্যোৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। প্রতি বছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের। বরং তা বাড়ছে নিরন্তর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জনপ্রতি আমাদের খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল দৈনিক ৪৫৬ গ্রাম, ২০০০ সালে তা ৫২২ গ্রাম এবং ২০২০ সালে তা ৬৮৭ গ্রামে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ দ্রুত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি। সম্প্রতি নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কৃষি খাতে। আগের খোরপোশ পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপখাতে।

বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কৃষি খাতকে। রাসায়নিক সারের দাম দফায় দফায় কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে পাঁচ দফায় কমিয়ে ইউরিয়া সারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি কেজি ১৬ টাকায়। টিএসপি সারের দাম ৮০ টাকা থেকে কমিয়ে ২২ টাকায়, এমওপি সারের দাম ৭০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকা, ডিএপি সারের দাম ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন তা কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ২৭ (ইউরিয়া), ২৭ (টিএসপি), ২০ (এমওপি) ও ২১ (ডিএপি) টাকায়।। গত ১৫ বছরে (২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩) শুধু সারেই ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। গত বছর তার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর চালু করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভর্তুকি। ৫০ শতাংশ (ক্ষেত্র বিশেষে ৭০ শতাংশ) ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি। মোট বাজেটের প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে কৃষি ভর্তুকি খাতে। তা ছাড়া দ্রুত হ্রাস করা হয়েছে কৃষিঋণের সুদের হার। এখন কৃষিঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৯ শতাংশ। মসলা ফসলের জন্য তা ৪ শতাংশ। দুগ্ধখামার করার জন্য ৫ শতাংশ। পানি সেচের আওতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে মোট আবাদি জমির ৭৪ শতাংশে। উচ্চফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানি জমি। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। ত্বরান্বিত হয়েছে খাদ্যনিরাপত্তা।

দানাদার খাদ্যশস্যের পর আলুর উৎপাদনে বিপুল উদ্বৃত্ত অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। দেশের মানুষের দৈনিক জনপ্রতি আলুর চাহিদা হচ্ছে ৭০ গ্রাম, প্রাপ্যতা অনেক বেশি। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে আমাদের আলুর মোট উৎপাদন ছিল প্রায় অর্ধকোটি টন। এখন তা ১ কোটি ৯ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে এখন আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। তাতে প্রতি বছর গড়ে আমাদের আয় হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। তা ছাড়া আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে এর ব্যবহারও বহুমুখী হচ্ছে। আগে আলুর ব্যবহার হতো মূলত সবজি হিসেবে। এখন তা চিপস ও পটেটো ক্রেকার্স হিসেবেও অনেক সমাদৃত। বিদেশিদের মতো অনেক বাংলাদেশিও এখন মূল খাদ্য হিসেবে রোস্টেড পটেটো খেতে পছন্দ করেন। আলু উৎপাদনে গত ২০ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।

খাদ্যশস্যের আর একটি বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে সবজি উৎপাদনে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সবজি উৎপাদন প্রতি বছর গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন ও ভারতের পর বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মৌসুমের শুরুতে বাজারে সবজির দাম ভালো থাকায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানি সম্প্রসারিত হওয়ায় দেশের কৃষকরা এখন সবজি চাষে বেশ উৎসাহিত হচ্ছেন। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন আধুনিক সবজি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্বীয় উদ্যোগে এরা গড়ে তুলছেন সবজি খামার।

বাংলাদেশে সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ফলের উৎপাদনে। বর্তমানে এ দেশে ফলের উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন। ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। গত ২ দশক ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল বছরে গড়ে ১১ শতাংশের ওপরে। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলের মাথাপিছু প্রাপ্যতা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। ২০০৬ সালে আমাদের মাথাপিছু দৈনিক ফল গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৫৫ গ্রাম, ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৫ গ্রামে। তাতে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে আমাদের পুষ্টিহীনতা। বর্তমানে আমাদের দেশে আমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চিরায়তভাবে গড়ে ওঠা রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুরের বাগানগুলো ছাপিয়ে এখন প্রচুর আম উৎপাদিত হচ্ছে সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায়। তা ছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক ধানিজমি পরিণত হয়েছে আম বাগানে। অধিকন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে নতুন ফল স্ট্রবেরি। আরও চাষ করা হচ্ছে রাম্বুতান, ড্রাগন ফল ও অ্যাভোকেডো। মানুষ আপেলের পরিবর্তে বেশি করে খাচ্ছে কাজী পেয়ারা। তাতে বিদেশি ফলের আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সাশ্রয় হচ্ছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা।

এ দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। দীর্ঘমেয়াদে এর আবাদি এলাকা কমেছে। তবে একরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। ২০১০ সালে পাটের জিন রহস্য উন্মোচনের ফলে এর উৎপাদন বৃদ্ধির পথ আরও সুগম হয়েছে। বিশ্ববাজারে এখন পাটের চাহিদা বাড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক করোনাকালেও পাটের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল বেশ চড়া। এখন দেশে কৃষকের খামারপ্রান্তে কাঁচা পাটের মূল্য ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা প্রতি মণ। এটা বেশ লাভজনক মূল্য। বর্তমানে দেশে পাটের উৎপাদন প্রতি বছর ৭৫ থেকে ৮৫ লাখ বেল। আগামীতে এর উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। অদূর ভবিষ্যতে আবার ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের পাটখাত।

কেবল শস্যখাতই নয়- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে কৃষির সব উপখাতেই বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এ দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭ লাখ টনে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ প্রায় ৮৫ শতাংশ এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত মাছের হিস্যা মাত্র ১৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা প্রায় ২৮ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে এবং ৫৭ ভাগ আসে বদ্ধ জলাশয় থেকে। সামুদ্রিক মৎস্যের শতকরা প্রায় ৮২ ভাগ জোগান আসে আর্টিশনাল বা চিরায়ত আহরণ পদ্ধতির মাধ্যমে। আর বাকি ১৮ শতাংশ আসে ট্রলারকেন্দ্রিক শিল্পায়িত আহরণের মাধ্যমে। বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের হিস্যা হ্রাস পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ আহরণের হিস্যা বেড়েছে। এর কারণ, সামুদ্রিক আহরণের প্রবৃদ্ধির হার কম, অভ্যন্তরীণ আহরণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে বদ্ধ জলাশয় তথা চাষাধীন জলাশয় থেকে আহরণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি বিধায় মোট মৎস্য উৎপাদনে এ খাতের হিস্যা দ্রুত বেড়েছে। গত ৩৬ বছরে (১৯৮৩-৮৪ সাল থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত) অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে মৎস্য আহরণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২.৭, ৮.৫৭ এবং ৩.৯৪ শতাংশ। এ সময় মাছের মোট উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ৫ শতাংশ হারে। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য। এর পেছনে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধিক উৎপাদনক্ষম মৎস্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গত ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রুইজাতীয় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পাঙ্গাশ, কৈ, শিং, মাগুর ও তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। তাতে অভ্যন্তরীণ পুকুর-দীঘিতে হেক্টরপ্রতি মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৫ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। মৎস্য খাতের উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- ইলিশের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া। ২০০৮-০৯ সালে ইলিশের মোট উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫ লাখ মেট্রিক টনে। নদীতে জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকরণ এবং ইলিশ প্রজনন সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ইলিশের উৎপাদন ও আকার আশাতীত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এ দেশে উৎপাদিত মোট মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনে দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক হিস্যা বাংলাদেশের রয়েছে। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। বিশ্ব দরবারে এর পরিচয় ‘বাংলাদেশ ইলিশ’ হিসেবে। এর ভৌগোলিক নিবন্ধন বা জিআই সনদ রয়েছে।

পুষ্টির অন্যান্য উপাদান ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশ এখন ডিম ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ম্ভর। দুগ্ধ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে যে হারে উৎপাদন বাড়ছে তাতে এর ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে অচিরেই। বর্তমানে (২০২১-২২ অর্থ বছরের তথ্যানুসারে) মাংসের উৎপাদন ৯২.৬৫ লাখ মেট্রিক টন। জনপ্রতি বার্ষিক প্রাপ্যতা ৫৪ কেজি। ডিমের উৎপাদন ২৩৩৫.৩৫ কোটি। বার্ষিক জনপ্রতি প্রাপ্যতা ১৩৬টি। দুধের উৎপাদন ১৩০.৭৪ লাখ মেট্রিক টন। জনপ্রতি বার্ষিক প্রাপ্যতা ৭৬ লিটার। তবে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় বাংলাদেশে মাংস, ডিম ও দুধের দাম বেশি। প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ হ্রাস করে ভোক্তাপর্যায়ে পশু-পাখি উপজাতের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন প্রযুক্তির ধারণ উৎসাহিত করা উচিত।

কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত বন। এ খাতে বৃক্ষের মোট আচ্ছাদিত এলাকা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৪ বছর আগে দেশের ৭-৮ শতাংশ এলাকা বৃক্ষাচ্ছাদিত বনভূমির আওতায় ছিল বলে ধরে নেওয়া হতো। এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৪৫ শতাংশে। উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী এবং গ্রামীণ কৃষি বনায়ন দেশের পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। বৃক্ষরাজী থেকে মানুষের পুষ্টি গ্রহণ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বনসম্পদের আরও দ্রুত সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক এগিয়েছে। ভূমি কর্ষণ, ফসল কর্তন ও মাড়াই, ধান ভানা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই এখন কায়িক শ্রমের ব্যবহার সীমিত হয়ে আসছে। বাড়ছে যন্ত্রের ব্যবহার। স্বাধীনতার পর ভূমি কর্ষণের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন করা হতো কাঠের লাঙল দিয়ে। ব্যবহার করা হতো পশুশক্তি। এখন পশুশক্তির ব্যবহার হ্রাস পেয়ে নেমে এসেছে ৫ শতাংশে। বাকি ৯৫ শতাংশই আবাদ হচ্ছে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। ধান কাটা ও মাড়াই ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখন বেশ প্রচলিত। তবে তার পরিধি এখনো বেশ সীমিত। বর্তমানে কৃষিযন্ত্র সংগ্রহে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকিমূল্যে যন্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। হাওর, চরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় ভর্তুকির পরিমাণ বেশি, ৭০ শতাংশ। তবে এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুবই কম। এটি বাছাইকৃতভাবে এখনো কার্যকর হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে চলছে শ্রমিক সংকট। তাতে দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে শ্রমিকের মজুরি। তদুপরি ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে সময়ক্ষেপণ, অপচয় ও অদক্ষতার কারণে কৃষির উৎপাদনে লাভজনকতা হ্রাস পাচ্ছে। এমতাবস্থায় কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত সম্প্রসারিত করা দরকার। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্প্রতি ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা হয়েছে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’। ভবিষ্যতে আরও বড় আকারের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে।

অধুনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্থায়িত্বশীল বা টেকসই কৃষি উন্নয়নের ওপর। কারণ কৃষি উৎপাদনের প্রধান ৩টি উপকরণ মাটি, পানি ও বায়ু সসীম। ইচ্ছে করলেই এদের সীমিত সরবরাহকে অসীম করা যাবে না। ভবিষ্যতে দ্রুত বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্যোৎপাদন করতে হবে; কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও পানির অভাব দারুণভাবে পরিলক্ষিত হবে। পৃথিবী পৃষ্ঠে বায়ুর অভাব আপাতত পরিলক্ষিত না হলেও জলবায়ুর উষ্ণায়ন আমাদের এক চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কৃষির উৎপাদনে তা এক মারাত্মক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। সে কারণে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন বলতে এমন একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যা ভবিষ্যতের জন্য সম্পদের মজুত অটুট রাখবে এবং তাতে প্রকৃতি ও এর কোনো অংশের বিনাশ সাধন করা হবে না। টেকসই উন্নয়ন মানুষের বর্তমান চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে; কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে তা সক্ষমতা ঘাটতির কোনো কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। টেকসই কৃষিব্যবস্থা বলতে এমন পরিবেশবান্ধব কৃষি কার্যক্রমকে বোঝায় যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ অক্ষুণ্ন রেখে মানুষের উৎপাদন চাহিদা মিটিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তাতে পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকবে। মানবগোষ্ঠী ও প্রাণিসম্পদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হবে।

টেকসই কৃষি উন্নয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা নির্মূল করা এবং সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করা টেকসই কৃষি উন্নয়নের আর একটি প্রধান লক্ষ্য। তা ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করা এবং বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা এর অন্য একটি লক্ষ্য। অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে আছে কৃষিজমিতে সবার অভিগম্যতা ও এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, শস্য ও প্রাণিসম্পদের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা, বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করা এবং কৃষিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

কৃষির বিভিন্ন উপখাতে ক্রমাগতই উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে এবং তা টেকসই করতে হলে এ প্রবৃদ্ধির হার আরও গতিশীল করা দরকার। সে কারণে কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার। জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের হিস্যা বাড়ানো দরকার। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে কৃষি খাতের বাজেট বরাদ্দ ও ভর্তুকি হ্রাস পেয়েছে। এখন তা কিয়দাংশ বৃদ্ধি পেলেও স্থায়িত্বশীল কৃষি উন্নয়নের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এর পরিমাণ আরও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষির চিরায়ত উৎপাদনব্যবস্থাকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত করার জন্য পুঁজির সঞ্চার ঘটাতে হবে। তা ছাড়া কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপনে এবং এর বিপণনে বিশেষ সহায়তা প্রদান করতে হবে। কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমকে চিহ্নিত করতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের খাত হিসেবে।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ; পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস এবং প্রাক্তন উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।


গ্রীষ্মের দাবদাহ ও বৃক্ষরোপণ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশকে সবুজায়নে অসম্ভব সাফল্য দেখিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের দিকে।

গণতন্ত্রের মানসকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সারা দেশে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শোনা যায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের প্রস্তুতির বিকল্প নেই- এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধু আগেই অনুধাবন করেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সঙ্গে সঙ্গে দেশকে সবুজায়ন, বনায়নের মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকি উপকূলীয় এলাকায় সবুজায়ন করার উদ্যোগও বঙ্গবন্ধুই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একজন পরিবেশ প্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে সব সময় পরিবেশের উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য দিতেন। এ সময়ে প্রচণ্ড দাবদাহের ফলে বঙ্গবন্ধুর এই সোনার বাংলায় চলছে দুর্বিষহ পরিস্থিতি।

গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, একবিন্দু পানির জন্য চারদিকে হাহাকার, জনহীন পথে মরীচিকার হাতছানি, তখন কবিগুরু প্রকৃতিকে বলছিলেন ‘তুমি কত নির্মম হবে হও সেই নির্মমতার সঙ্গেই হবে আমার মিলন।’ তাই তো কবিগুরু তার কবিতায় লিখেছেন-

‘নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।

খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা।।

যদি ঝরে পড়ে পড়ুক পাতা,

ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা,

থাক জনহীন পথে পথে মরীচিকাজাল ফেলা।।

শুষ্ক ধূলায় খসে পড়া ফুলদলে

ঘূর্ণী- আঁচল উড়াও আকাশতলে।

প্রাণ যদি করো মরুসম

তবে তাই হোক- হে নির্মম,

তুমি একা আর আমি একা,

কঠোর মিলনমেলা।।’

এপ্রিল মাসজুড়ে সারা দেশে বয়ে গেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এবং মে মাসেও তা চলছে। এই তীব্র গরমে সুস্থ থাকার উপায় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খানের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তিনি বলেন, ‘হিমশীতল বা লু-হাওয়া যে তাপমাত্রাই হোক না কেন, মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া তার নিজের তাপমাত্রা ৩৭.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নির্দিষ্ট রাখতে চায়।

শরীরে তাপমাত্রার তারতম্যের কারণেই কেবল মানুষ জাগতিক কাজকর্ম করে থাকে। কিন্তু সূর্যের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল তাপমাত্রা নির্দিষ্ট একটি মাত্রায় ঠাণ্ডা রাখার জন্য শরীরকে বাড়তি কাজ করতে হয়। এর ফলে ত্বকের কাছাকাছি রক্তবাহী ধমনিগুলো তীব্র তাপ চারপাশে ছড়িয়ে দিতে বেশি করে কাজ করতে শুরু করে, আর তখনই ঘাম হতে শুরু করে। শুনতে খুব সাধারণ শোনালেও, শরীরের জন্য ব্যাপারটি মোটেও সহজ নয়। যত গরম, মানব শরীরের জন্য তা সামলানো তত কঠিন। ত্বকের নিচের ধমনিগুলো যখন খুলে যেতে থাকে, তখন রক্তচাপ কমে যায় এবং হৃৎপিণ্ডের কাজ বাড়িয়ে দেয়। শরীরের সবখানে রক্ত পৌঁছে দিতে হৃৎপিণ্ডকে তখন দ্রুত পাম্প করতে হয়।

এর ফলে শরীরে হালকা র‍্যাশ বা দানা দেখা দিতে পারে, মানে ছোট ফুসকুড়ির মতো যা চুলকাতে পারে। অথবা কারও পা ফুলে যেতে পারে গরমে। কিন্তু রক্তচাপ বেশি কমে গেলে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। সেই বেশি ঘামের কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে। এই গরমে ঠাণ্ডা পানি খাওয়া একেবারেই উচিত না। বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে রোদ এড়িয়ে চলে বাইরে বের হতে হলে যতটা সম্ভব ছাতা, টুপি বা কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হবে। বিশেষ করে সুতির তৈরি হালকা রঙের পোশাক পরা ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা প্রয়োজন। সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং বাসি, খোলামেলা খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলা দরকার। তীব্র গরমে কাউকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখলে কী করা উচিত, সে বিষয়ে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ কিছু পরামর্শ দিয়েছে।

  • ঐ ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব ঠাণ্ডা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
  • শুইয়ে দিতে হবে, এবং তার পা কিছুটা ওপরে তুলে দিতে হবে।
  • প্রচুর পানি বা পানীয় খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে, পানিশূন্যতা দূর করার পানীয় দেওয়া যেতে পারে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করতে হবে, ভেজা কাপড় বা স্পঞ্জ দিয়ে মুছে দেওয়া যেতে পারে পুরো শরীর।

বগলের নিচে এবং ঘাড়ে-গলায় ঠাণ্ডা পানি দেওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু ৩০ মিনিটের মধ্যে যদি সুস্থ না হয়, তাহলে ঐ ব্যক্তির হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কালক্ষেপণ না করে তক্ষুনি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। হিটস্ট্রোক হলে মানুষের ঘেমে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

সে ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ঐ ব্যক্তি।

এই গরমে সবারই একটু বুঝতে হবে, কাদের ঝুঁকি বেশি?

অতি গরমে স্বাস্থ্যবান মানুষের হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন।

শুরুতেই বয়স্ক, বৃদ্ধ এবং যাদের আগে থেকেই অসুস্থতা রয়েছে, তাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে অনেকাংশে বেশি।

যাদের ডায়াবেটিস টাইপ ওয়ান বা টু রয়েছে, তাদের শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে এবং কিছু জটিলতা দেখা দেয়।

এ ছাড়া বাচ্চাদের খুব কষ্ট হয় বেশি গরমে।

অনেক সময় বাচ্চারা বা শিশুরা নিজেদের অস্বস্তির কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না, যে কারণে মা-বাবারা সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে পারেন না।

বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে তাপপ্রবাহের কারণে তীব্র গরম চলছে। আরও কয়েকদিন দেশে তীব্র গরম থাকবে জানিয়ে সম্প্রতি ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় গরমের তাপমাত্রা এর মধ্যেই রেকর্ড অতিক্রম করেছে।

প্রচণ্ড গরমের কারণে দেশের অনেক স্থানে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

চিকিৎসকরা বলেছেন, এ রকম তীব্র গরমের সময় সতর্ক না থাকলে শারীরিক নানা সমস্যার পাশাপাশি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।

এই তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা পশুপাখিদেরও। তাদের ভয়াবহ করুণ পরিস্থিতি দেখা যায় চিড়িয়াখানায় গেলে, সেখানে দেখা যায় নেই বাঘের হুংকার, নেই বানরের লাফালাফি, হাতিদের খেলা, রোদের খরতাপে পাখিদের বেড়েছে অস্বস্তি, থেমেছে কলকাকলী, একত্রে চাঞ্চল্য হারিয়েছে যেন সব পশুপাখি, দর্শনার্থীর সংখ্যাও হাতে গোনা, দু-একটি ময়ূরের ডাক ছাড়া পুরো চিড়িয়াখানা জুড়েই লক্ষ করা যায় সর্বত্র বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।

এই সময়ে দেশের কোথাও কোথাও অল্পবিস্তর বৃষ্টিও হয়েছে, আবহাওয়াবিদরা আগাম বন্যারও আশঙ্কা করছেন।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষরাজি শুধু কার্বন নিঃসরণ কমায় না; শব্দদূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বনের জমি পাইকারি হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সবুজ গাছের সঙ্গে জীবশ্রেণির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রাণীর অস্তিত্ব বজায় রাখতে গাছ প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই স্থান-পরিক্রমায় জীবকুলের উপকারার্থে স্রষ্টা উদ্ভিদকুলকে বৈচিত্র্যময় করে সাজিয়েছেন। তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় পরস্পর নির্ভরশীল। অথচ এ দেশে প্রতিনিয়ত গাছ কর্তন করে শুধু মানুষরাই নিজেদের সব প্রাণিকুলের সর্বনাশ ডেকে আনছে। গাছ কাটা প্রতিরোধ করে মানুষের বসবাসে পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানোর বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়ে জানা যায়, সবাই ব্যাপক ভিত্তিতে সারা দেশে গাছ লাগানোর পক্ষে।

পরিবেশের দূষণ ও বিপর্যয় রোধে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। প্রকৃতি ও আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষার্থে গাছ লাগানো জরুরি।

এ কথা সত্য যে, গাছ মানুষের নিঃস্বার্থ ও উপকারী বন্ধু। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা জরিপ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৃক্ষ বা উদ্ভিদের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। এ দেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে প্রতিনিয়ত নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে, যা পরিবেশের ওপর হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের আয়তনের অনুপাতে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সেই পরিমাণ বনভূমি এ দেশে নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বনবিষয়ক এক প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। যদিও সরকারি হিসাবে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৭ শতাংশ বলা হয়ে থাকে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি জাতীয় ঐতিহ্য, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, ইত্যাদিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধ, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাসহ নৈসর্গিক শোভাবর্ধনে গাছের অসীম গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের প্রতি বছর বাড়ির আশপাশে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা খোলা জায়গায় সাধ্যমতো ফলজ এবং ঔষধি গাছ লাগানো উচিত। তবেই আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশও ভালো থাকবে।

আমাদের ধর্মীয় দিক, অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষা অনুসারে একজন মুমিন ও মুসলিম সর্বদা পরিবেশবান্ধব। যে ব্যক্তি অকারণে ছায়াযুক্ত গাছ কেটে ফেলে, তাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। আবদুল্লাহ বিন হুবশি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অকারণে একটি কুলগাছ কাটবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৫২৩৯)

আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ এবং বৈষম্য আমাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রখর সতর্কতা এবং পারিবারিকভাবে, শিক্ষাকেন্দ্রে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে আরও বেশি বৃক্ষরোপণ করার ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক


বিদায় হজের ভাষণ

আপডেটেড ১০ মে, ২০২৪ ১৬:৪৯
আতিকুল ইসলাম খান

এই ভাষণই ইসলাম ধর্মের শেষ খুতবা বলে আখ্যায়িত। দশম হিজরিতে আরাফার ময়দানে জুমার দিন সংগঠিত, আখেরি নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই ভাষণে সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা, বিদ্রোহ এবং কুপরামর্শ প্রদানকারী শয়তানের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এই ভাষণে বিভিন্ন সুদ প্রথা রোহিত করে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয় বরং সমগ্র বিশ্বমানবতার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুরাতুল আরাফে আল্লাহ বলেন; ও নবী আপনার উম্মতকে জানিয়ে দিন, আজকের দিনে ইসলামকে আমি জীবন বিধান হিসাবে তোমাদের জন্য কবুল করলাম। এই আয়াত শুনে একজন ইহুদি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ.)কে বলেছিল এমন একটা দিন পেলে আমরা ইহুদিরা ঈদের দিন বানিয়ে নিতাম। এ কথা শুনে হজরত ওমর (রা.) আল্লাহর কসম করে বললেন, নিশ্চয়ই আজকের এই দিন মুসলমানদের ঈদের দিন এবং এই জুমাবারে সাপ্তাহিক ঈদ পালন করার দিন। এই ভাষণ হচ্ছে তেইশ বছরের নবুওয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস।

বিদায় হজের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা-

১) হে মানব মণ্ডলী---

তোমরা হৃদয়ের কর্ণে ও মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শ্রবণ করো, আমি জানি না আগামী বছর এ সময়ে এ স্থানে এ নগরীতে সম্ভবত

তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ হবে কি না।

২) হে মানব সকল ---

সাবধান! সব প্রকার জাহিলিয়াতকে আমার দুই পায়ের নিচে পিষ্ট করে যাচ্ছি। নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হলো।

প্রথমে আমি আমার বংশ থেকে রবিয়া বিন হারেস বিন আব্দুল মুত্তালিবের রক্তের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রের দুধ পান করেছে। হুযাইল তাকে হত্যা করেছে।

৩) হে মানুষ সকল ---

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ‘সুদ’কে চিরদিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

৪) হে লোক সকল ---

বলো আজ কোন দিন? সবাই বলল, আজ মহান আরাফার দিন। আজ হজের দিন। সাবধান! আজকের এই দিন জুমার দিন। এই মাস জিলহজ মাস। এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র, তোমাদের জান মাল ইজ্জত মান-সম্মান আবরু কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র। তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত, তার মাল, সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান, আজকের দিনের মতোই পবিত্র। এই হারাম মাসের মতো হারাম অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম। তোমাদের কাছে একজনের গচ্ছিত সম্পদ এ সম্মানিত নগরীর মতো পবিত্র আমানত। সাবধান! মানুষের আমানত, প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে।

৫) হে মানুষ সকল ---

ঋণ অবশ্যই তোমাদের ফেরত দিতে হবে। বিশ্বস্ততার সাথে প্রত্যেকের আমানত রক্ষা করতে হবে। তোমরা কেউ দুর্বলের ওপর অবিচার করবে না। কারও সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারও জন্য হালাল নয়।

৬) হে মানব সকল ---

নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন। তোমাদের পিতাও একজন। তোমরা সবাই আদম (আ.) থেকে আর আদম (আ.) মাটি থেকে সৃষ্টি। তোমাদের সবার পিতা আদম (আ.)। হে মানবজাতি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো। অতএব শুনে রাখ, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। অন্ধকার যুগের কৌশিল্য বিলুপ্ত করা হলো। শুধু কাবা ঘরের তত্ত্বাবধান ও হাজীদের পানি পান করানো ছাড়া। আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার ওপর কালোর আর কালোর ওপর সাদার কোনো মর্যাদা নেই।

তাকওয়াই শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে। তোমাদের মাঝে যারা মুত্তাকি, আল্লাহভীরু, কেবল তারাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান।

৭) হে লোক সকল ---

পুরুষদের নারী জাতির ওপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তবে, নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ করো। নারীদের ওপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের ওপরও রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে আল্লাহর আমানত হিসেবে আল্লাহর কালিমার মাধ্যমে হালাল করে গ্রহণ করেছ। স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে তারা যেন নিজ স্বামী ছাড়া পর পুরুষের সঙ্গে ভোগে লিপ্ত না হয়। যদি তারা তা করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তাদের প্রতি কঠোরতার অনুমতি দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তোমরা তাদের শয্যা পৃথক করে দেবে এবং মৃদু প্রহার করবে। তাতে তারা বিরত হলে নিয়মাফিক তাদের ভরণ পোষণের প্রতি লক্ষ রাখবে। স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, কেননা তারা তোমাদের সহযোগী ও সাহায্যকারিনী।

৮) হে উপস্থিত সকল ---

মুমিনরা পরস্পর ভাই আর তারা সকলে মিলে এক অখণ্ড ভ্রাতৃসমাজ। এই ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করবে না।

তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে কিছু দেয়, তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেও না। পরস্পর খুনাখুনি করো না এবং তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।

৯) হে মানুষেরা ---

তোমরা শুনে রাখ, শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে সামর্থ্য হবে না। তবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সতর্ক থাকবে এবং তার অনুসারী হবে না।

১০) হে আল্লাহর বান্দা ---

তোমরা আল্লাহর বন্দেগি করবে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে। রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে এবং জাকাত আদায় করবে। তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করতে পারবে।

১১) হে মানুষ সাবধান ---

তোমরা তোমাদের গোলাম ও অধীনস্থদের বিষয়ে আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করো। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে, তাদেরকেও সেভাবে পরতে দেবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করবে।

১২) হে মানুষ ---

বিশ্বাসী তো সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্যের সম্মান ধন প্রাণ নিরাপদ। সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অন্যের জন্যও তাই পছন্দ করে।

১৩) হে মানুষ ---

তোমরা ঈর্ষা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে, ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সব সৎ গুণকে ধ্বংস করে দেয়। শুনে রাখো, আজ হতে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বা কৌলিন্য প্রথা বিলুপ্ত করা হলো। কৌলিন্য বা শ্রেষ্ঠ সেই- যে বিশ্বাসী ও মানুষের উপকার করে।

১৪) হে লোক সকল ---

আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’য়ালার পয়গাম পৌঁছে দেইনি? তখন লোকেরা বলল, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন; আমার বিষয়ে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে- সেদিন তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে? সকলে এক বাক্যে বলে উঠল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আমাদের নিকট রিসালাতের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। উম্মতকে সব বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন এবং সব গোমরাহির আবরণ ছিন্ন করে ওহির আমানত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ শাহাদাৎ অঙ্গুলি আকাশের দিকে তুলে তিনবার বললেন, হে আল্লাহ তা’য়ালা! আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।

১৫) হে মানুষেরা ---

আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার থেকে কম বেশি করবে না। উত্তরাধিকারীর জন্য কোনো অসিয়ত প্রযোজ্য নয়। সাবধান! অন্যদের জন্য এক-তৃতীয়াংশের অধিক ওসিয়ত করা বৈধ নয়।

১৬) হে মানব মণ্ডলী---

সন্তান যার বিছানায় জন্মগ্রহণ করবে সে তারই হবে। ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে প্রস্তরাঘাত, অর্থাৎ সন্তানের জন্য শর্ত হলো তা, বিবাহিত দম্পতি হতে হবে। ব্যভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই।

যে সন্তান আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা এবং যে দাস নিজের মালিক ব্যতীত অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে, তাদের ওপর আল্লাহতা’য়ালা ফেরেস্তাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ। তার ফরজ নফল কোনো ইবাদতই কবুল হবে না।

১৭) হে কুরাইশ সম্প্রদায়---

তোমরা দুনিয়ার মানুষের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন কিয়ামতে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করো, কেননা, আমি আল্লাহর আজাবের মোকাবেলায় তোমাদের কোনো উপকার করতে পারব না। তোমাদেরকে দেখেই লোকেরা আমল করবে। মনে রেখ সকলকে একদিন আল্লাহ তা’য়ালার নিকট হাজির হতে হবে। সেদিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন।

১৮) হে মানুষ সকল ---

তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না। পরস্পর মারামারি হানাহানিতে মেতে উঠবে না। আমিই আখেরি নবী। আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না। আমার সাথেই ওহির পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে।

১৯) হে মানুষেরা ---

তোমরা জেনে রাখ, আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। সুতরাং আমাকেও আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। (সুরা ইসরাইলের প্রথম আয়াতের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)কে আবদ্ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আবদ্ অর্থ বান্দা। আল্লাহই ভালো জানেন, তবে মাটি আর নূর নিয়ে তর্ক বিতর্ক করার আগে প্রাধান্য দিতে হবে তিনি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানব সমাজে মনুষ্য আচরণ প্রদর্শনের জন্য তিনি মাটির সৃষ্টি হলেও সে মাটি ছিল অসাধারণ, নূরের থেকেও শ্রেষ্ঠ।

২০) হে মানুষ সকল ---

শুনে রাখ আমার পরে আর কোনো নবী নেই। হে মানুষ আমি তোমাদের কাছে দুটি আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এই দুটি অনুসরণ করবে, ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। এর একটি হলো ‘আল্লাহর কিতাব আর অপরটি আমার জীবন দৃষ্টান্ত।’

২১) হে মানব মণ্ডলী---

তোমরা নেতার আনুগত্য করবে এবং তার কথা শ্রবণ করবে। যদিও তিনি হন হাবশী ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তার কথা শুনবে এবং তার নির্দেশ মানবে ও তার প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন তিনি আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবেন, তখন থেকে তার কোনো কথা শুনবে না এবং তার আনুগত্যও করা যাবে না।

২২) হে মানুষ সাবধান ---

তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পরবর্তীরা এই বাড়াবাড়ির করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এই নির্দেশটি হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কোনো বিধর্মীকে বাড়াবাড়ি বা জোর জবরদস্তি করে ইসলামের দীক্ষা দেওয়া যাবে না। তবে, একজন মুসলমানকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইসলামী জিন্দেগী অবলম্বন করে জীবন যাপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই।

২৩) হে মানুষ ---

প্রত্যেককে শেষ বিচারের দিনে নিজেদের কাজের হিসাব দিতে হবে, অতএব তোমরা তোমাদের কর্মের ব্যাপারে সাবধান হও।

২৪) হে মানুষ ---

শুনে রাখ, অপরাধের দায়িত্ব কেবল অপরাধীর ওপরেই বার্তায়, অর্থাৎ পিতা তার পুত্রের জন্য আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী হবে না। যার যার কর্মফল তাকেই ভোগ করতে হবে।

২৫) হে মানুষ ---

তোমরা ইসলামি জ্ঞান অর্জন করবে, কেননা, ইসলামি জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য অপরিহার্য, কারণ জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। জ্ঞানবিহীন মানুষ অন্ধ। মূলত, ইসলামি জ্ঞান ছাড়া একজন মানুষ মূর্খ ছাড়া কিছুই নয়।

২৬) মনে রেখ মানুষ ---

আমি তোমাদের সকলের আগেই হাওজে কাওসারে পৌঁছে যাব এবং তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। আর অন্য সকল উম্মতের মধ্যে তোমাদের আধিক্য নিয়ে আমি গর্ব করব। অতএব হে আমার উম্মতেরা, তোমরা বিদায়াত সৃষ্টি করে আমার চেহারায় কালিমা লিপ্ত করো না।

২৭) তোমরা শুনে রাখ ---

আমি সেদিন অনেককে মুক্ত করব, যারা কোরআন সুন্নার ওপর অটল থেকে দুনিয়া হতে বিদায় হবে এবং অনেকে সেদিন আমার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে তারা হলো, যারা ইসলামের মধ্যে বিদায়াত সৃষ্টি করেছে এবং যারা আমার পরে আমার সুন্নত অর্থাৎ দ্বীনকে পরিবর্তন করেছে।

২৮) অতঃপর তিনি বলেন---

আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি? সকলেই বলল ‘নিশ্চয়ই’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) শাহাদাত আঙ্গুলি আকাশের দিকে তুলে আবার বলবেন; হে আল্লাহ তা’য়ালা! আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।

২৯) হে উপস্থিতগণ--

তোমরা অনুপস্থিতদের নিকট আমার এই পয়গাম পৌঁছে দেবে। হয়তো বা তাদের মধ্যে কেউ এ নসিহতের ওপর তোমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে আমল করবে। তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।

পৃথিবীর মহামনীষিদের বাণী কখনো সত্য কখনো মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মুহূর্তের জন্য মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না। একটি সুন্দর বাণীর কারণে মানুষ হয় বিশ্ববিখ্যাত আবার একটি অসুন্দর বাণীর কারণেই মানুষ হয় বিশ্বকুখ্যাত। তাইতো আমাদের জাতীয় কবি ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ বলেছিলেন, আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান?

আয় আল্লাহ! আমাদেরকে প্রিয় নবীজির আদর্শের সেই মুসলমান হওয়ার সঠিক জ্ঞান দান করুন। ‘আমীন’

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।


বাংলাদেশ হাইকমিশন যুক্তরাজ্যের কাছে প্রত্যাশা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. আজিজুল আম্বিয়া

বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের প্রধান কূটনৈতিক মিশন। হাইকমিশন লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনের কুইন্স গেট রাস্তায় অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকার ম্যানচেস্টার এবং বারমিংহামে অবস্থিত দুটি সহকারী হাইকমিশন ও পরিচালনা করে। অধিকন্তু এটির আয়ারল্যান্ডের সমবর্তী স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে অনুমান করা হয় যে প্রায় ৫৫০০০০ বাংলাদেশি এখানে বসবাস করছেন। যাদের মধ্যে ৯৫% অভিবাসী সিলেটি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক বাস করছেন পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হেমলেটে যা ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৩৩ ভাগ। এ কারণে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনের চেষ্টা কওরা উচিত বলে গুণীজন মনে করেন। তাই হাইকমিশন ও এই এলাকায় বিশেষ তৎপরতা চালিয়ে যান। বাংলাদেশি সিলেটিরা এখানে সুপ্রতিষ্ঠ। বর্তমান হাইকমিশনার যিনি অনেকটা সফল হিসেবে অনেকে মনে করেন। তিনি হলেন সাইদা মুনা তাসনিম । তিনি অনেক ভালো কাজ করার চেষ্টা করছেন বলে এখানকার মানুষের ধারণা রয়েছে। তার অনেক সুনাম ও রয়েছে দেশে ও বিদেশে। এ কূটনীতিবিদরা বাংলাদেশের বৃহৎ দাবিগুলো নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাব আনেন এবং দাবি জানান। তারা দেশের জন্য কাজ করেন নিরলসভাবে। উনারা এখান থেকে দেশের জন্য কূটনৈতিক কাজ চালিয়ে যান ইউকেসহ সারাবিশ্বের সঙ্গে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বাজেটের টাকার সিংহভাগ গিয়েছিল এই দেশের ব্রিটিশ বাঙালিদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দেশের মানুষের বিরাট ভূমিকার কারণে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে জীবিত অবস্থায় পাকিস্তানিরা এই দেশে পাঠাতে বাধ্য হয়। আর এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের উদ্দেশ্যে ফিরে যান তার দেশে। তাই এই দেশ বাঙালির অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে । এ কারণে সব সময় বাংলাদেশের কাছ থেকে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে যুক্তরাজ্য কিন্তু অভিযোগ আছে এখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী মানুষ পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সার্ভিস। ২০১৮ নভেম্বর মাস থেকে এখন পর্যন্ত সাইদা মুনা তাসনিম এই দায়িত্বে আছেন। তিনি সম্প্রীতি তার কাজের জন্য ডিপ্লোম্যাট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। তিনি কাজ করে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনছেন অথচ এখানকার অনেক বাঙালি এই হাইকমিশন অফিসের কর্মচারীদের কাজে খুশি হতে পারছেন না এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। অবশ্য বর্তমান হাইকমিশনার আসার পর সেবার মান উন্নত করার চেষ্টা করছেন এবং করেও যাচ্ছেন কিন্তু এই অর্জন ম্লান করে দিচ্ছেন উনার অফিসের এই কিছু কুচক্রী লোক। মানুষকে সঠিক সেবা দেওয়ার স্বার্থে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার এখন সময় এসেছে বলে সুশীলরা মনে করছেন। এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করা হয় মর্যাদার সঙ্গে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করা হয় দিনরাত। বর্তমান হাইকমিশনার আসার পর সর্বপ্রথম বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ দেখা করলেন । বাংলাদেশের জাতীয় দিবসে এখন এই দেশের অনেক জায়গাতে বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়তে দেখা যায়। বাংলাদেশ হাইকমিশন বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য বিভিন্ন সভা ও সেমিনার এর আয়োজন করে থাকে যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ অবদান রাখছে । বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে যে যে কাজ করা হয় তা হলো- ই-পাসপোর্ট ও মেশিন রিডাবল পাসপোর্ট (এমআরপি), এনআইডি, ভিসা, প্রত্যয়ন দলিল, জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু নিবন্ধন, পাওয়ার অব এটর্নি, দ্বৈত নাগরিক সনদপত্র, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, পুলিশ কিলিয়ারেন্স ফর ফরেন ন্যাশনাল, ভ্রমণের অনুমতি, নো ভিসা রিকয়ারড (এনভিআর), বিভিন্ন অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব কাজ করতে আসা মানুষের নানা অভিযোগ রয়েছে। হাইকমিশনের ওয়েবসাইট এ যে হেল্প নাম্বার দেওয়া রয়েছে তাতে কল করলে সব সময় উত্তর আসেনা অন্যান্য হাইকমিশনের মতো। ওয়েবসাইট ও উন্নতমানের নয় এই অভিযোগ অনেকেই করেন । এখানে সহজে প্রবেশ করা যায়না সব সময়। এ ছাড়া এখানে কিছু বুঝতে অক্ষম হলে সাহায্য করার মতো কাউকে পাওয়া যায় না। অফিসে গেলে তারা বলেন, এটা করেন, ওটা করেন কিন্তু দেখানের কেউ নেই তাই মানুষ বাধ্য হয় দালালের কাছে যেতে। আর দালালরা প্রতিটি কাজে ৩০ পাউন্ড থেকে ৬০ পাউন্ড পর্যন্ত চার্য করে থাকেন । উপায় নেই তাই মানুষকে এই টাকা দিতে হয়। হেল্পলাইনে কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে তা অজানাই থেকে যায় অনেকের। তখন অসম্পূর্ণ কাজ নিয়ে অফিসে যেতে হয়। সেখানে গিয়েও অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয় এই সাধারণ মানুষের। অথচ এই দেশে অন্যান্য হাইকমিশনে কল করার সঙ্গে সঙ্গে অপশন আসে এখানে কোনো অপশন চান সেটি পছন্দ করার জন্য বলা হয় এবং যে বিষয়ে দরকার সেই বিষয়ে পরামর্শদাতা নিজে কথা বলেন ফোনে এবং যেকোনো সমস্যার ও সমাধান করে দেন নিজে । এখানে কিন্তু এটি স্বপ্ন। অথচ একই দেশে দুই সিস্টেম চালু রয়েছে। তাই দিন দিন মানুষ এই প্রতিষ্ঠানকে অথর্ব বলে ভাবতে শুরু করেছে। ইমেইল করলেও সঙ্গে সঙ্গে অনেকে রেস্পন্স পান না বলে অভিযোগ আছে। সিরিয়াল এ অনিয়ম নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেছে অনেকে মনে করেন বলে গুজব আছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সম্মানিত নাগরিকবৃন্দকে সিরিয়ালে নাম ডাকার সময় সম্মানের জায়গাতে অসম্মানিত করা হচ্ছে অবস্হা দৃস্টে অনেকে ভাবেন এই কথা। কেউ কেউ জানান মনে হয় পাকিস্তানের কোনো অফিসে বাঙালিকে কটাক্ষ করে কেউ নাম ডাকছেন, সিরিয়াল অনেক সময় বেশ দীর্ঘ হয় কিন্তু ট্র্যাভেল এজেন্সির লোক বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে দেখা যায় হরহামেশা। এই হলো সাধারণ মানুষের অভিযোগ। অফিসের ভিতরের লিফট নষ্ট কিন্তু এটি কেন ঠিক হচ্ছে না কেন তা জানা নেই মানুষের। তাই অক্ষম ব্যক্তিরা ই ভিসার আবেদন করলে সম্ভব হচ্ছেনা এই কাজ সম্পন্ন করা । কারণ মেশিন রাখা হয়েছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে তাই এ কাজ কি করে করা সম্ভব? সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় তাদের তখন দীর্ঘসময় বসে থাকতে হয় তা দুই তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ও ছাড়িয়ে যায় অনেক সময় এটি হলো ভুক্তভুগোদের কথা। এ ছাড়া শুনতে হয় অনেক তিরস্কার, অফিসাররা খুব ব্যস্ত থাকার বান করেন, যেখানে ইউকে সরকার সিলেটি ভাষাকে সম্মান করে বিভিন্ন জায়গাতে সিলেটি অনুবাদক রেখেছেন সেখানে অনেক স্টাফ আছেন এখানে তারা এই ভাষাভাষী মানুষদের অবজ্ঞা করছেন বলে শক্ত অভিযোগ আছে এই দেশের মানুষের কাছ থেকে। কেউ কেউ নীরবে হজম করছেন এই অবজ্ঞাকে। এরকম ও অভিজ্ঞতা আছে অনেকে বলেন , অনেক সময় লাইনে থেকে অনেককে বলতে শুনা যায় আমারা তাদের দেশের লোক না । মানে সিলেটি না হলে হয়তো ভালো ব্যবহার পাওয়া যেত। সিলেটিরা এই বিসয়ে খুব ক্ষুদ্ধ বলা যায়। সিলেট অঞ্চলের মানুষ বেশি এই দেশে তবুও কেন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হাইকমিশন অফিসে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ১ দুই জনের বেশি সিলেটি লোকজন কে চাকরি দিতে চায়না বাংলাদেশ সরকার এই প্রশ্ন এখন সব সিলেটি মানুষের মনে। তাই তারা এখন নারাজ বলা যায় সরকারের ওপর।

সেবা নিতে আসা অনেকে জানান, কর্মচারীদের কাউকে যদি বলা হয় আমাদের ট্যাক্সের টাকায় সরকার আপনাদের বেতন দেয় তবে কেন আপনারা এই কাজে আমাদের ঠিকমতো সহযোগিতা করেন না? তখন তিনি জানান, আপনাদের টাকায় আমাদের বেতন হয় না; কিন্তু প্রশ্ন হলো এ রকম উত্তর কি শুভা পায় একজন সরকারি কর্মচারীর মুখে। এ দেশে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অনেক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ লাভ করেন নিয়মিত কিছু মানুষ। এরা এই কমিশনের পছন্দের লোক বলা যায়। কিন্তু বিশাল এই দেশে যে অন্য গুণীজনরা রয়েছেন বা তৈরি হচ্ছেন সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মনে হয় এই কমিশনের । তাই এই তালিকার বাহিরের কিছু সুশীলরা দাওয়াতের বাহিরে থাকেন সব সময় । লন্ডনে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে হাই কমিশনের তেমন একটা তৎপরতা দেখা যায়না । এদেশে বছরে একবার বইমেলা হলেও হাইকমিশন অফিস থেকে কোনো অর্থনীতিক সহযোগিতা করতে পারছেন বলে কোনো খবর মিলছে না; কিন্তু এই দেশে যারা বসবাস করেও বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করছেন তারা খুব একটা সচ্ছল নয়, আমরা তা জানি। তাই এই বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত বলে সুশীলরা মনে করেন। এদিকে পাসপোর্ট করতে আসা অনেক ব্রিটিশ নাগরিকরা জানান, অফিসের অসহযোগিতা আর অনিয়মের কারণে মনে হয় বাংলাদেশি পাসপোর্ট না করলেই ভালো হতো। কেন এই বিতৃষ্ণা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এখানে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত তৈরি করা উচিত। যেখানে মানুষ রিপোর্ট করতে পারবে সহজে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার লাভ করতে পারবে। এখানে অনেক সময় বিচার দেওয়ার জন্য ও সঠিক জায়গা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বিচারপ্রার্থী হলে কর্মকর্তারা দায় এড়ানোর জন্য বলেন লিখিত অভিযোগ করেন। এই সময় এ দেশের মানুষের সবার নেই এটা তারা জেনেই এই সুবিধা নেন বলে অনেকে ধারণা করেন । যদি বাংলাদেশ সরকার ছদ্ম বেশে একদল তদন্তকারী সেখানে প্রেরণ করে, তবে এই অনিয়ম চোখে পড়বে বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন এবং সব অফিসে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে যদি আসা হয় আর তা যদি প্রতিনিয়ত চেক করা হয় তবেই এই অনিয়ম চোখের সামনে আসবে আর এই অসাধু লোকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক


নাম না জানা দেশই হোক তারুণ্যের কর্মসংস্থান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রফেসর ড. মো. নাছিম আখতার

শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ গড়তে চাই জনগণের কর্মসংস্থান। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের চাকরি। সৎ উপায়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাদের দেশ অত্যন্ত জনবহুল দেশ। এ দেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ স্বভাবতই দেশের জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। তাই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে রয়েছে হতাশা ও উৎকণ্ঠা। একটি জাতীয় পত্রিকার পরিসংখ্যানে দেখেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের প্রায়ই ৬৪ শতাংশ বেকার থাকছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও চাকরিবিহীন গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। শিক্ষিত হওয়ার ফলে তরুণ প্রজন্মের দ্বারা খেত-খামারে কাজ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে, আবার চাকরিও দুর্লভ। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পিয়ন পোস্টে ৪টি পোস্টের জন্য ১৬ শ আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে আবার অসংখ্য আবেদনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনার্স-মাস্টার্স। একটি সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে দেখেছিলাম ২১টি পৃথক পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ১ লাখ ২১ হাজার। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি সরকারি চাকরির জন্য মানুষ ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে তদবির করছে, যা দেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের শামিল। এমন কঠিন প্রতিযোগিতাময় পরিবেশে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে থাকছে চরম হতাশা। এখান থেকেই মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার মতো মানসিক সমস্যা বেড়েই চলেছে। আবার এসব তরুণকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজের স্বার্থান্বেষী ও দুর্জন ব্যক্তিরা অপকর্মে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি জাতীয় পত্রিকার একটি খবরে দেখলাম শিক্ষিত এক তরুণকে ব্যবহার করা হয়েছে একজন রাজনীতিবিদকে খুন করার জন্য। বিনিময়ে তার আগের সব মামলা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ যত বাড়ানো যাবে এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ততই কমবে। তরুণ প্রজন্মের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন নয়, দরকার কর্তৃপক্ষের প্রজ্ঞা ও শিক্ষিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষই দেশটির নাম জানেন। দেশটি ওসেনিয়ার অন্তর্গত একটি দেশ। নাম তার ‘পালাও’। ৪৬৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে ২২ হাজার লোকের বসবাস। যার মধ্যে ২ হাজার লোকই বাংলাদেশি। ২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সুপারি বাগানের সুপারি তোলা ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া বাঙালিরা সেখানে সমুদ্রে সার্ফিং এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশটির মাথাপিছু আয় ১৭ হাজার ৪৩৮ মার্কিন ডলার। এমন নাম না জানা দেশে মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগই বাঙালি। পৃথিবীতে এমন নাম না জানা বা কম পরিচিত অনেক দেশ আছে যেখানে আইন-শৃঙ্খলা, পরিস্থিতি, বসবাসের পরিবেশ আকর্ষণীয়। এসব দেশে বেঁচে থাকার মতো কর্মসংস্থান তৈরি করার উদ্যোগ, চেষ্টা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটানো যেতে পারে। তাহলেই দূর হবে বেকার সমস্যা।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সবাই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভিন দেশে নিজেদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তৈরি করেছিল। উপনিবেশগুলো থেকে আহোরিত অর্থ জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা ও শিল্পোৎপাদন ব্যবহার করে তারা উন্নত ও ধন সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমে এসে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো ইউরোপ এবং আমেরিকার উন্নত দেশগুলি প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠনে আফ্রিকার দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের চাহিদার বিরাট অংশ আসে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। আফ্রিকানদেরকে মদ ও মাদকে আসক্ত রেখে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ, বিগ্রহে ব্যস্ত রেখে ইউরোপিয়ানরা নির্বিঘ্নে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিচ্ছে।

করোনা মহামারি একটি বিষয় আমাদের শিখিয়েছে তা হলো শুধু টাকা থাকলেই চলবে না। জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের মৌলিক প্রাকৃতিক রসদ দেশের মধ্যেই থাকতে হবে। করোনার সময় সিঙ্গাপুরে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। কারণ শিল্প ও ব্যবসায় উন্নত হলেও সিঙ্গাপুর তার মোট চাহিদার ১০ ভাগ খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করে। বাকি অংশের জন্য তারা বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। করোনায় সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ায় সেখানে খাদ্যাভাব হয়েছিল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সারা পৃথিবীতে তেল, গ্যাস খাদ্য দ্রব্যের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই যুদ্ধে ইউরোপের প্রাকৃতিক সম্পদের দেউলিয়াত্ব বিশ্ববাসীর কাছে ফুটে উঠেছে। তাই ইউরোপকে শুধু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে ধরলে আমাদের জন্য বোকামি হবে।

আফ্রিকার মহাদেশের কথা শুনলেই অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি মহাদেশের কথা মনে পড়ে। আফ্রিাকার দেশগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখি তাহলে আমাদের আজন্মকাল লালিত ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটবে- আফ্রিকার শহরগুলোর অবকাঠামোগত সৌন্দর্য আমাদের আধুনিক ইউরোপের কথা মনে করিয়ে দেবে। ২০২১ সালের গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) সূচক অনুয়ায়ী আফ্রিকার ১০টি দেশ যথাক্রমে মরিশাস, বতসোয়ানা, ঘানা, জাম্বিয়া, সিয়েরা লিওন, সেনেগাল, তানজানিয়া, নামিবিয়া, লাইবেরিয়া ও মালাউই এর শান্তির সূচক যথাক্রমে ২৮,৪১,৩৮,৭১,৪৬,৫৪,৫৮,৬৫,৭৬ ও ৫৯। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে একই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম। আফ্রিকার ধনী দেশের মধ্যে রয়েছে সিশেলস, মরিশাস, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, গ্যাবন, বতসোয়ানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মিশর। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া অন্য নয়টি দেশেই জীবন ও জীবিকা অত্যন্ত নিরাপদ। গ্লোবাল ইকোনমি ফোরামের তথ্য মতে ২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার মোট জিডিপি হবে ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই।

২০২১ সালে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) র‌্যাংকিংয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে উরুগুয়ে, চিলি, আর্জেটিনা, প্যারাগুয়ে ও পেরু। এখানে উল্লেখ্য উরুগুয়ের জিপিআই সূচক যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে বড় দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ গায়ানা। যা বিট্রিশ কলোনি ছিল এবং এখানকার মাতৃভাষা ইংরেজি। এর জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ এবং সাম্প্রতিক কালে তেল উত্তোলিত হচ্ছে। তেলনির্ভর এই দেশটি বাংলাদেশিদের কর্মক্ষেত্র হতে পারে। এর পাশেই রয়েছে সুরিনাম নামে আরও একটি বাংলাদেশের সম আয়তনের দেশ যা হল্যান্ড শাসিত ছিল। লোকসংখ্যা ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার। এ দেশটিও শিক্ষিত বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের নতুন গন্তব্য হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘অর্থনৈতিক কূটনীতিতে গুরুত্ব দিতে হবে।’ তিনি বলেন ‘আজকের বিশ্বে কূটনৈতিক মিশনগুলোর দায়িত্ব পরিবতর্তিত হয়েছে। এখন রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি অবলম্বন করতে হবে, যাতে আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদার করতে পারি ও বিশ্বের সবার সঙ্গে একত্র হয়ে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারি।’ আমিও মনে করি, সচেতন মানুষ যাদের কর্মকাণ্ড দেশের সার্বিক পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারে তাদের স্লোগান হওয়া উচিত- ‘দূরদর্শী পরিকল্পনা করি, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ি।’

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আবুল কাসেম ভূঁইয়া

প্রকৃতি বাংলাদেশকে অপরূপ সৌন্দর্য দান করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক বেশি। তাই তো অতীতকাল থেকেই বিদেশি পর্যটকদের আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আকৃষ্ট করে আসছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। দেশের পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় এবং মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭৫ সালের দিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত পর্যটন করপোরেশন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে পর্যটন করপোরেশন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে অসংখ্য মোটেল, হোটেল, রেস্ট হাউস গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশে পর্যটন মৌসুম শুরু হয় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এ সময় দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। বাংলাদেশের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। এখানে সারা বছর ধরে পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। বিশেষ করে শীত মৌসুম পর্যটকদের ভিড় বেড়ে যায়। পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কক্সবাজারকে আকর্ষণীয় সাজে সজ্জিত করা হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে মানোন্নত রেল যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে মানোন্নত রেলযোগাযোগ চালু করা হচ্ছে। এই রেল যোগাযোগ চালু হলে পর্যটননগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ অনেকটা বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার রেল সার্ভিস চালু হলে পর্যটকরা সস্তিতে যাতায়াত করতে পারবে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে সরাসরি বিমান সার্ভিস চালু আছে। সড়ক পথে আন্তর্জাতিক মানসম্মত বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। পর্যটনশিল্পনির্ভর খাবার হোটেলসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখানে রয়েছে। কক্সবাজার পর্যটনশিল্পের সঙ্গে হাজার হাজার লোক সম্পৃক্ত রয়েছে। কক্সবাজার ছাড়া এখানে রয়েছে হিমছড়ি, ইনানী এবং টেকনাফ সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজারের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন স্পট। কাপ্তাই রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে রয়েছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। কাপ্তাইয়ে রয়েছে আকর্ষণীয় লেক, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র, রাঙামাটিতে রয়েছে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান, বান্দরবানে রয়েছে মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরি পর্যটন স্পট। বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ঘেরা মনোরম দৃশ্য পর্যটকদের সহজেই আকৃষ্ট করে থাকে। বান্দরবানে রয়েছে অসংখ্য উন্নতমানের হোটেল এবং রিসোর্ট। খাগড়াছড়িতে রয়েছে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাজেক। যাকে বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড বলা হয়। সাজেকে রয়েছে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা। তবে যাতায়াতব্যবস্থা এত উন্নত নয়। চট্টগ্রামেও রয়েছে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, ফয়েজলেক, বাটালী হিল, ওয়ার সেমিট্রি, চেরাগীর, পাহাড়, ভাটিয়ারী গলফ, কর্ণফুলী নদীর তীর পার্কি বিচ, সিআরবি, স্বাধীনতা পার্কসহ আরও অনেক দর্শনীয় স্থান। এসব স্থানে সবসময় পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। মিরসরাইয়ে রয়েছে মহামায়া লেক, সীতাকুণ্ডে রয়েছে সীতাপাহাড়। কুমিল্লায় রয়েছে ময়নামতি বৌদ্ধবিহার, বার্ড, লালমাই পাহাড়, ময়নামতি ওয়ার সেমিট্রি, ধর্মসাগর, রানীদীঘি, নানুয়াদীঘিসহ আরও নতুন নতুন পর্যটন স্পট। প্রাকৃতিকভাবে অপরূপ সাজে সজ্জিত সিলেটে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাফলং, রাতারকুল, বিছানাকান্দি, লালাখাল, চাবাগানসহ আরও অনেক পর্যটন স্পট। এসব পর্যটন স্পটে সবসময় পর্যটকরা আসেন। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। এ ছাড়া পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, মহাস্থানগড়, কুয়াকাটাসহ আরও অনেক পর্যটন স্পট বাংলাদেশে রয়েছে। দেশের এসব পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করলেও এসব স্থানে বিরাজ করছে বিভিন্ন সমস্যা। যা নাকি পর্যটকদের দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দেয়। বিশেষ করে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে পর্যটকরা চরম দুর্ভোগ পোহান। প্রায়ই পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের জন্য টয়েলেটে, রেস্ট হাউস, উন্নতমানের খাবার হোটেল, নামাজের স্থান নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ আরও অনেক সমস্যা। দেশের পর্যটনশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এই শিল্পকে যদি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে এই শিল্প থেকে সরকার প্রচুর রাজস্ব আয় করতে পারবে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের বিভিন্নস্থানে অবস্থিত পর্যটন স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় এবং উন্নতমানের করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোতে বিরাজমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে ডকুমেন্টারি ফ্লিম বা অ্যাড নির্মাণ করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, টিভি ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার এবং পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রিন্টিং মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোর প্রচারের জন্য তরুণদের নিয়োগ দিতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে তুলে ধরার লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচারণা চালাতে হবে। পর্যটকদের এদেশে আসার জন্য ভিসার সহজ ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি পর্যটকরা যাতে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন সে জন্য তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য ট্রেন, বাস, বিমানে বিশেষ সুযোগ রাখতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোতে বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্নত খাবার এবং বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে অর্থ আয়ের ব্যবস্থা করছে। আমাদের পার্শবর্তী রাষ্ট্র ভারতের পর্যটনশিল্প অনেক সমৃদ্ধশালী। প্রতি বছর ভারতে লাখ লাখ বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। এই বিদেশি পর্যটকদের দ্বারা ভারত সরকারের বিশাল আয়ের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। ভারত সরকার তাদের পর্যটনশিল্পকে দিন দিন আকর্ষণীয় করে তুলছে। ভারত ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নেপাল, দুবাই এখন পর্যটনশিল্পনির্ভর হয়ে পড়েছে। এসব দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা আসেন। আমাদের দেশের পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দেশের পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্ততাদের এগিয়ে আসতে হবে। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকলে দেশের পর্যটনশিল্প অনেক এগিয়ে যাবে। পর্যটনশিল্পের প্রকৃত উন্নয়ন আশা করছি।

লেখক: অর্থনীতিবিষয়ক প্রাবন্ধিক


কেন দেশের আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছে?

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মিজানুর রহমান 

এপ্রিল/২৪ থেকে সব অঞ্চলের মানুষ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পড়েছে। ঈদ ছুটি শেষ হতে না হতেই সপ্তাহব্যাপী মানুষের মুখে তীব্র গরমের কথা শোনা যাচ্ছে। দিন শুরু না হতেই ঝাঁজাল রোদ্দুর। মানুষ বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। বৈদ্যুতিক পাখা এ গরম সামাল দিতে পারছে না। এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকার বন্ধ ঘোষণা করেছে। হিট অ্যালার্ট জারি হয়েছে। বেশি কষ্ট হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের। ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে হিট স্ট্রোকে ২০ এপ্রিল/২৪ পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। ফোরকাস্টিং তথ্য মোতাবেক গত ৭৬ বছরে অমন গরম হাওয়া বইতে দেখা যায়নি। ২১ এপ্রিল/২৪ তারিখে আবহাওয়ার ফোরকাস্টিং থেকে আরও জানা যায় দেশের কয়েকটি এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির খবরে দেশবাসী শঙ্কিত যেমন- ষশোর ৪২.৬০ চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৪০ রাজশাহী ৪১.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস একই দিনে সৌদি আরবে ৩৮ বাহরাইনে ৩২ কাতারে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে দেশের তাপমাত্রা সৌদি আরবের চেয়েও বেশি। দেশের তাপমাত্রা এভাবে বেড়ে যাওয়াটা আমরাও কম দায়ী নই। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যেকোনো দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার; কিন্তু পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এ বছরের তথ্য মোতাবেক দেশে বনভূমির পরিমাণ ১৫ দশমিক ৫৮ ভাগ। কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে উজাড় হচ্ছে সেভাবে বৃক্ষরোপণ হচ্ছে কি? নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, এক সময় এ দেশে ১৩০০ নদী ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মোতাবেক এখন আছে ৪০৫টি, সেগুলোও হজম করার পাঁয়তারা চলছে। খাল-বিল-জলাশয় ভরাট করে ফসলি জমি ঘরবাড়ি করা হচ্ছে। বাধা দেওয়ার যেন কেউ নেই।

রাজধানী ঢাকায় অসহনীয় গরম পড়ছে। ঢাকায় নিজেদের ভোগ-বিলাসের জন্য পরিবেশের ওপর আমরাও অনেক আঘাত হেনেছি। তথ্যানুযায়ী গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের করা এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ কমে মাত্র ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে জলাভূমি নেমে এসেছে ২ দশমিক ৯ শতাংশে। ঢাকায় মাত্র ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় গাছপালা ও খালি জায়গা রয়েছে যা ১৯৯৫ সালে ছিল ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে জলাভূমি এলাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার। যা ১৯৯৫ সালে ছিল ৩০ দশমিক ২৪ বর্গকিলোমিটার। একটি আদর্শ শহরে ১৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ শতাংশ জলাভূমি থাকার নিয়ম রয়েছে। অন্যদিকে বারবার চুয়াডাঙ্গায় কেন তাপমাত্রা বেশি হচ্ছে সেটাও সবাই অবগত হলে বুঝতে বাকি থাকবে না নদী ও বনভূমির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। এ মাসে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। কেন সে জেলায় এত দাবদাহ? ভৌগোলিক দিক বিশ্লেষণে জানা যাবে এর কারণ কি? ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের যে অবস্থান সেই একই অবস্থানে আছে ভারতের রাজস্থান, সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের মরুভূমিগুলো অর্থাৎ এদেশগুলো একই অক্ষাংশে। প্রশ্ন জাগে উল্লিখিত অঞ্চলগুলো মরুভূমি হলে বাংলাদেশে কেন অমনটি নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ম্যাপে দৃষ্টিপাতে দেখা যাবে যে ম্যাপের মাঝামাঝি একটি রেখা অতিক্রম করেছে যার নাম হচ্ছে কর্কটক্রান্তি রেখা যা ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে। এই কর্কটক্রান্তি রেখাটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে প্রভাবিত করছে। আমরা জানি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এক সময় ঘুরতে ঘুরতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সরে যায়। এ সরে যাওয়ার কারণেই পৃথিবীর নির্দিষ্ট কয়েকটি অঞ্চল সরাসরি সূর্যের নিচে চলে আসে। যার কারণে উত্তর দিকের ২৩.৫ ডিগ্রি ও দক্ষিণ দিকে ২৩.৫ ডিগ্রির জায়গাটুকু সূর্যের সরাসরি নিচে অবস্থান করে। এ ২৩.৫ ডিগ্রি অক্ষাংশের রেখাটি বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে অতিক্রম করছে। পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে ২১ মার্চের পর ধীরে ধীরে উত্তর অংশ সূর্যের নিচে অবস্থান করে। আর যেহেতু চুয়াডাঙ্গার ওপর দিকে কর্কটক্রান্তি রেখাটি, স্বাভাবিকভাবে এ জেলার তাপমাত্রা অনুভূত হবেই। এ কর্কটক্রান্তি রেখা কিন্তু কুমিল্লা ও ফরিদপুরের দিক দিয়েও বিদ্যমান তাহলে সেখানে তাপমাত্রা তেমনটি নেই কেন? আমরা জানি জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে সমুদ্রের অবস্থান, প্রবাহিত নদী ধারার অবস্থান এবং ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর। তিনটি বিষয় চুয়াডাঙ্গার অনুকূলে নেই। সমুদ্র থেকে আসা বায়ুপ্রবাহের কারণে বায়ুমণ্ডলে নিয়ন্ত্রণ করে যেমন অধিক শীতল আবার অধিক গরম হতেও দিচ্ছে না। যার কারণে সমুদ্র তীরবর্তী জেলাগুলো যেমন পটুয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট এবং কক্সবাজারের আবহাওয়া খুবই সহনীয় পর্যায়ে থাকে। ফরিদপুরের পাশে আছে বিশাল নদী কুমিল্লার পাশে আছে ত্রিপুরার বিশাল বনভূমি যা আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। চুয়াডাঙ্গায় নেই সমুদ্র, নেই নদী পথ, নেই বনাঞ্চল। সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া চুয়াডাঙ্গা জেলা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১১.৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। যার ফলে পানির লেয়ারও অনেক নিচে অবস্থান করে। পানির লেয়ার নিচে থাকলে দ্রুত মাটি উত্তপ্ত হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে একই অক্ষরেখায় অবস্থিত ভারতের রাজস্থান সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের মরুভূমি এলাকা। ওই এলাকাগুলো মরুভূমি হওয়া সত্ত্বে ও বাংলাদেশের বেলায় তেমনটি না হওয়ার কারণ হলো, আমরা জানি বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বাড়লে সমুদ্র থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প উপকূলের দিকে ধাবিত হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এর জলীয়বাষ্প বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ধাবিত হলেই উত্তর অঞ্চলের হিমালয়ের পর্বতে ধাক্কা খেয়ে মেঘমালা তৈরি হয় এবং ধরণিতে বৃষ্টি নেমে আসে। এ সুবিধাটুকু তো ভারতের রাজস্থান সৌদি আরব এবং আফ্রিকার উত্তর অংশের বেলায় নেই। বলাবাহুল্য বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে চমৎকার একটি দেশ। এ কারণে বাংলাদেশে মরুভূমি হয়নি। এ উত্তপ্ত পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতে চুয়াডাঙ্গাবাসীকে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে সবুজ-শ্যামল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে তখনই দেখা যাবে চুয়াডাঙ্গায় প্রচুর বৃষ্টি হবে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে। সামগ্রিকভাবে তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচতে হলে বনভূমি ধ্বংস আমরা না করি, ব্যক্তি স্বার্থে নদী ভরাট করা যাবে না নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে হবে। এ ছাড়া কলকারখানার নির্গত ধোঁয়া, যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস আমাদের বাতাসকে কলুষিত করছে। বাতাসের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃতি যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ফিরে না আসে কি হতে পারে তা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান দাবদাহ থেকে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। সরকার ও কঠোর অবস্থানে যেতে হবে, তাহলে পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষা পাবে এবং বর্তমান অবস্থান থেকে আমরাও পরিত্রাণ পাব।

লেখক: সাবেক ব্যাংকার ও কলামিস্ট


কর আহরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমরা কোথায় পিছিয়ে কেন?

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ

ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম, বিশেষ করে কর আহরণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে সেসব দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়নের কারণে। যেমন- ভারত ১৯৬১ সালে, মালয়েশিয়া ১৯৬৭ সালে ঔপনিবেশিক আমলের আয়কর আইনকে যুগোপযোগী করে নেয়। ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া কয়েক বছর পরপর তাদের আয়কর আইনকে রীতিমতো ঢেলে সাজায়। একই সমতলে অবস্থানরত কমনওয়েলথ সদস্য দেশ বাংলাদেশে আয়কর আইনের আধুনিকতম সংস্করণ ১৯৮৪ সালে, তাও অর্ডিন্যান্স আকারে। তা যুগোপযোগী করতে, আইন আকারে পাস ও প্রবর্তনের কসরত চলছে গত দেড়যুগ ধরে। বাংলাদেশ ও ভারতের করব্যবস্থা, সুবিধা, ফরম্যাট মূলত একই। তবে একটা বড় প্রশাসনিক পার্থক্য হলো, বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর, এক মন্ত্রণালয় এবং একজন প্রশাসনিক চেয়ারম্যানের অধীনে। ভারতে তা নয়, সেখানে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ করের প্রশাসন আলাদা। ভারতে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের এবং পরোক্ষ কর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেও ভারতের কর বিভাগ বাস্তবায়নকারী হিসেবে স্বশাসিত। কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পলিসি প্রেসক্রিপশন ও থ্রেসহোল্ড দেওয়ার ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও একটা শক্তিশালী অবস্থান যেমন আছে তেমনি রাজ্যপর্যায়ে আছে স্থানীয় কর আইন ও ব্যবস্থাপনার সমান্তরাল প্রণয়ন ও প্রয়োগের সুযোগ।

আরেকটি হলো হিসাব সংরক্ষণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। বাংলাদেশেরও আছে; কিন্তু হিসাব পদ্ধতি, কোম্পানির আইন সবমিলিয়ে দেশগুলোতে একটা টেকসই সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও সে সড়কে বাংলাদেশের ওঠার প্রয়াস প্রলম্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এক হাতে হয়। তাই এখানে ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতিগত বিষয়গুলো অনেক জটিল, স্বেচ্ছা ব্যাখ্যা আচারি ও নিবর্তনমূলক হয়ে ওঠে। অনেকক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যা ধোঁয়াশে হয়ে যায়। ভারতে ভিয়েতনামে মালয়েশিয়ায় ওই সমস্যা তেমন একটা নেই। তারা অনেকটা স্বচ্ছ সংহত একটা আধুনিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে।

ভারতে পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কারণ দেশটির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আমদানি-রপ্তানির নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে যেহেতু শুল্কের ও মূল্য সংযোজন করের বিষয় জড়িত, সেহেতু সে মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হয়েছে শুল্ক ও ভ্যাট দপ্তরকে। ভ্যাট আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তনে বাংলাদেশ যথেষ্ট ধীর এবং এখনো দোটানায়। ভ্যাট মধ্যস্বত্বভোগকারীদের দখল থেকে সরকারি তহবিলে আনার আইন-কানুন কলাকৌশল যেন সহজেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বাংলাদেশে আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো যে মূল্য নির্ধারণ কিংবা ট্যারিফ ঠিক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ট্যারিফ কমিশন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এনবিআর শুল্ক কর হার নির্ধারণ ও আরোপের সময় সেটিকে তেমন একটা আমলে নেয় না। একইভাবে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক পরিশোধসংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপন জারি করতে গেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি আনতে হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের মধ্যে মতামতের রশি টানাটানিতে শুল্ক আহরণ মাঠে মারা যায়। এই ঝামেলা ভারতে নেই, নেই মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে, ভিয়েতনামের পরিস্থিতি আরও স্বচ্ছ ও সাবলীল। ভারতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই আমদানি-রপ্তানি বিধির আলোকে শুল্ক করাদি আরোপ করে। ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় শুল্কায়ন সিদ্ধান্তদানকারী টায়ার বা লেয়ার অনেক কম। অধিকাংশ দেশে ট্যারিফ কমিশন শুল্ক আরোপ থেকে শুরু করে সবকিছু দেখে। বাংলাদেশের ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে এনবিআরের সুযোগাযোগ নেই। গণশুনানি করে ট্যারিফ কমিশন; কিন্তু শুল্ক আরোপ করে এনবিআর। এই জটিলতা নিরসনে সংস্কারের কথা বলা হলেও তাতে খুব একটা অগ্রগতি নেই।

কর ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে আছে ভিয়েতনাম। দেশটির করব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মৌল পার্থক্য হলো ব্যক্তি এবং করপোরেট কর সম্পূর্ণ ব্যক্তি বা কোম্পানির ওপরই অর্পিত। কর পরিশোধ তাদের দায়-দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি যা ঘোষণা দেবে, তার ভিত্তিতেই করারোপ হবে। কালেভদ্রে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা দ্রুত নিরীক্ষা ও নিরসন করা হয়। নিরসনের স্বাধীনতা সেখানে দেওয়া আছে। ব্যক্তিকরের ক্ষেত্রে ইউনিভার্সাল সেলফ অ্যাসেসমেন্ট বাংলাাদেশে প্রবর্তনের সময় মনে করা হয়েছিল, ব্যক্তি করদাতাদের যদি কর অফিসে এসে রিটার্ন পূরণ করতে হয় তাতে অনেক সময় লাগে এবং জনে জনে এভাবে পরীক্ষা করে নেওয়াও সম্ভব নয়; কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ইউনিভার্সল সেলফ ডিক্লারেশন সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না এই অনুযোগ অভিযোগ সন্দেহে অডিটের নামে করদাতাদের বারবার ডাকা হচ্ছে। এতেই কর প্রদানে আগ্রহ ও দায়িত্বশীলতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। ব্যক্তিকে যে ঘোষণা করার অধিকার দেওয়া হলো, শেষপর্যন্ত পারস্পরিক সংশয় সন্দেহ হয়রানির অভিযোগের ভাগাড়ে পড়ে অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। নোটিশ পেয়ে অফিসে গিয়ে ধন-সম্পদেও ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে করদাতারা অনেকক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে প্রায়ই অভিযোগ উঠছে। আবার করদাতারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন না বলে রাষ্ট্র ও রেভিনিউয়ের স্বার্থে তাদের ডাকতে হচ্ছে। সীমিত লোকবল সম্পন্ন কর বিভাগের মনোযোগ ও সময় বিদ্যমান কর দাতাদের পিছনে ব্যয়িত হচ্ছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য এখানে। সেখানে আয়করের ক্ষেত্রে বলে দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব ব্যক্তির, কোম্পানির। কর যা দেওয়া হবে, কর অফিস তাই নেবে। এভাবেই চলছে। কোনো কোনো সময় অভিযোগ পেলে সেটি খতিয়ে দেখা হয়। বাংলাদেশের মতো গয়রহভাবে অডিট করা হয় না সেখানে। সেখানে কর আইন বেশ সুসংজ্ঞায়িত এবং বিস্তৃত। সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে সব কিছু। ফলে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগগুলো তেমন নেই। প্রতি বছর সংস্কার ও সহজীকরণের দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি।

বাংলাদেশে সহজীকরণের প্রয়াস চলছে তো চলছেই, পদ্ধতি সাপোর্ট করছে না। ঘুরে-ফিরে দেখা যায় একটা আন্তঅবিশ্বাস বিরাজ করছে। পরস্পরকে এড়িয়ে যাওয়ার এবং ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টাও চলছে। এ ধরনের ঘটনা ভিয়েতনামে খুব কম। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও সহজ ও পদ্ধতিমাফিক করায়ন ও আহরণের এবং বিভিন্ন কর রেয়াতের ব্যবস্থাও আছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য হলো এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক কর সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা থাকলেও রাজস্ব বিভাগের কাছে গিয়ে বাস্তবে তা আরেক রকম মনে হয়। একটার সঙ্গে আরেকটার সঙ্গতি নেই। ভিয়েতনামে এ ধরনের জটিলতা ও অসঙ্গতি খুব একটা নেই। রাজস্ব বিভাগ যা বলছে, সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানও তাই বলছে। বাংলাদেশে এরকম সমরূপতা নেই। ভিয়েতনামে বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আসার পেছনে এই নীতিগত সংহতি একটা বড় ভূমিকা রাখছে।

মালয়েশিয়ায় যেমন মাইডা (মালয়েশিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) সার্বিকভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমন্বয় করে। সেখানে কর, কাস্টম পলিসি সব এক জায়গাতে করা হয়েছে। অর্থাৎ মাইডা যা বলবে ওটাই শেষ কথা। ভিয়েতনামের সঙ্গে মালয়েশিয়ার পার্থক্য হচ্ছে তারা সব বিষয়গুলো সমন্বয় করে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের কাছে সব ধরনের ক্ষমতা দিয়েছে।

১৮৬০ সালে জেমস উইলসন ( ১৮০৫-১৮৬০) ব্রিটিশ ভারতে প্রথম আয়কর আইন প্রবর্তন করেন। ব্রিটিশরা ভারতের শাসনভার নেওয়ার পর প্রথম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিল তাকে। ১৮৫৯ সালে তিনি ভারতে আসেন, ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল তিনি প্রথম বাজেট বক্তৃতায় ‘জনসেবার’ জন্য রাজস্ব আহরণের যে ফর্মাট -ফর্মুলা দিয়েছিলেন, এখনো বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কমনওয়েলথ দেশগুলোতে তা অনুসরণ করা হচ্ছে। শুধু সংস্কার হয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি কর সংস্কৃতিতে ও অবকাঠামোয় ততটা উন্নত নয়, সেহেতু উন্নত বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি, রীতিপদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন সরাসরি কাট পেস্ট করে অনুসরণে সাফল্য আসতে ও টেকসই হতে বিলম্ব হচ্ছে। যে স্টেজে যে অ্যাটিচুড বা মনোভঙ্গি (মাইন্ডসেট) বা উপলব্ধি থাকার কথা সেটায় না থেকে যদি এটা ভাবা হয়, উন্নত অর্থনীতির মতো আমাদের- সব করদাতারা শিক্ষিত, করদানে দায়িত্বসচেতন এবং তারা আইনকানুন সব বোঝেন জানেন, তাহলে কর-দৃষ্টিভঙ্গি (মাইন্ডসেট) ভিন্ন আঙ্গিকে চলে যাবে। এমনতরো অবস্থায় রাজস্ব আহরণ পরিবেশ পরিস্থিতি প্রোগ্রেসিভ না হয়ে রিগ্রেসিভ হতে পারে। নতুন করদাতা আসতে যেহেতু চাচ্ছে না, বা তাদের আনা যাচ্ছে না, সেহেতু তাদের স্থলে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপ বেড়ে গেলে তারাও পথ খুঁজতে পারেন কীভাবে কর দেওয়া থেকে ফাঁকি দিয়ে পরিত্রাণ মিলতে পারে।

বাংলাদেশ রাজস্ব আহরণের অবস্থান ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় পিছিয়ে থাকার আর যেসব কারণ তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য অবারিত কর অব্যাহতি আর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি। বাংলাদেশে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের জন্য দেয় কর ও জরিমানা আরোপের সঙ্গে অনৈতিক পন্থায় অর্জিত আয়ের ওপর কর হার হ্রাস বা জরিমানা ছাড় দেওয়ার কিংবা ‘উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না করার সুযোগ দেওয়াকে এক করে দেখা হয়। দেখা যায়, একজন লোকের অপ্রদর্শিত অর্থ ঘোষণার সুযোগে দুর্নীতিজাত কালো টাকার মালিককে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ কর ছাড়। এটি একটি বড় ধরনের কর প্রণোদনা। আবার বলা হচ্ছে, কালো টাকার উৎস নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না অর্থাৎ দুর্নীতিবাজকে রাষ্ট্র সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বরং ইমিউনিটি দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতে ১৯৯৭ ও ২০১৫ সালে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সেখানে করের ও জরিমানার হার হ্রাস, জিজ্ঞাসাবাদেও অব্যাহতি ছিল না আর এ সুযোগ ছিল নির্দিষ্ট সীমিত সময়ের জন্য। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায়ও তাই। বাংলাদেশেই এসবের ব্যতিক্রম একমাত্র বাংলাদেশেই।

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই  

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদনব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি- সব মিলিয়ে আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের চমকপ্রদ উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে দেশের সামগ্রিক আর্থিক লেনদেন কার্যক্রমে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনে নতুন এক বিপ্লব ঘটেছে। প্রান্তিক মানুষও এখন ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য ও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এটা আজ সবাই উপলব্ধি করেছেন, আর্থিক খাতে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব। আগে দূরবর্তী উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে ব্যাংক থেকে সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভাতা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বয়স্ক, বিধবা, অসচ্ছল, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের অনেক দুর্ভোগ কষ্ট পোহাতে হতো। সাধারণ দুস্থ, দরিদ্র অসহায় মানুষের সেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দিনের অবসান ঘটেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের জাদু সব কষ্ট, দুর্ভোগ এক নিমিষেই দূর করে দিয়েছে তাদের। এখন ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা তাদের ভাতার টাকা পেয়ে যাচ্ছেন দ্রুত এবং ঝামেলাবিহীনভাবে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস মানে এমএফএস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুণ এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে বলা যায়। বাংলাদেশ এখন হাতে হাতে নগদ লেনদেনের বদলে নগদবিহীন আর্থিক লেনদেনের অর্থাৎ ক্যাশলেস সোসাইটির কথা ভাবছে। নগদ লেনদেনের ঝুঁকি ঝামেলা ও বিড়ম্বনা এড়াতে ডিজিটাল মানি ট্রান্সফারে ঝুঁকে পড়ছেন দেশের মানুষ। এটা ডিজিটাল বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক প্রকাশ।

ডিজিটাল বাংলাদেশ যুগে প্রবেশের কারণে আমাদের জীবনযাপন অনেকটা পাল্টে গেছে। আজকাল ব্যাংকের শাখায় না গিয়েও চেক উপস্থাপন না করে টাকা তোলা যাচ্ছে এটিএম বুথ থেকে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দ্রুত এবং খুব কম সময়ে বিভিন্নজনের কাছে টাকা পাঠানোর অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আগে ব্যাংকে গিয়ে টিটি কিংবা ডিডি অথবা পে অর্ডার ইস্যুর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হতো। তাতে অনেক সময় লেগে যেত প্রাপকের কাছে টাকা পৌঁছাতে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী স্বপ্ন হচ্ছে দেশের সব ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন ক্যাশলেস হয়ে যাবে। নগদ অর্থে আর লেনদেন হবে না, উন্নতির ধারাবাহিকতায় এমন পরিবেশের দিকে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। ক্যাশলেস সোসাইটি হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মাত্র ৫ সেকেন্ডে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গ্রহীতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা এই সেবা পাওয়া যাবে। এতে সাধারণ মানুষ তাদের মোবাইল ফোনে টাকা পাবে। যে টাকাটা তারা একটা দোকানে গিয়ে খরচ করবে, সেটাও তারা মোবাইলে পেমেন্ট করে দেবে। তাদের হাতে আর ক্যাশ রাখার প্রয়োজন হবে না। তাদের কষ্ট করে আয় করা টাকাটা তাদের থেকে কেউ চুরি করে নিতে পারবে না। ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ হলে দুর্নীতি নির্মূলেও তা ভূমিকা রাখবে। আজ বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। তারা এখনো সম্পূর্ণ নগদ অর্থে লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল। তবে এই নগদ টাকা তো চুরি হতে পারে। তাদের টাকা লুট হতে পারে; এখানে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। আমরা যখন ক্যাশলেস সোসাইটিতে চলে যাব, তখন দুর্নীতির সুযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। আজ যত সরকারি ভাতা দেওয়া হয়, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেওয়া হয়। আগে টাকা চুরি হওয়ার, দুর্নীতি করার সুযোগ থাকত। সে সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ডিজিটাল আর্থিক সেবা অর্থাৎ ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবার বিকাশ এখন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করেছে। মোবাইল ফোন এবং ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার ধরনও পাল্টে গেছে এখন। ডিজিটাল ফাইন্যান্স অনুন্নত গ্রামীণজীবনে অত্যাধুনিক আর্থিক লেনদেন সেবাকে সহজলভ্য করেছে। যা আগের গতানুগতিক, প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না। কয়েক বছর আগেও যা কল্পনা করা যায়নি তা এখন সম্ভব হয়েছে। এখন ডিজিটাল রেমিটারের মাধ্যমে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ খুব কম সময়ের মধ্যে সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। গ্রামীণ দারিদ্র্যের মোকাবিলায় সরকারি নানা উদ্যোগ, প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী এবং গতিশীল করেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ফাইন্যান্স। আমাদের দারিদ্র্য দূরীকরণে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের বিভিন্ন বিষয় ইতোমধ্যে উজ্জ্বল সাফল্য দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়েছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের কোনো বিকল্প নেই, এটা সবাই উপলব্ধি করেছেন এর মধ্যেই। উদ্ভাবনী ক্ষমতার চর্চা এবং ডিজিটালাইটেজেশন বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করবে আশা করা যায়। উচ্চাভিলাসী হলেও সরকারি এবং বেসরকারি নানা উদ্যোগ এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন আর্থিক অনুদান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিভিন্ন ধরনের ভাতা খুব সহজে সুবিধাভোগীর হাতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল ফাইন্যান্স বা আর্থিক ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশের সর্বস্তরের জনগণকে আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আনাটা মস্তবড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সে চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে থাকায় তাদের পক্ষে আর্থিক লেনদেন বেশ কঠিন ছিল; কিন্তু ডিজিটাল ফাইন্যান্স তাদের জন্যও আর্থিক লেনদেনের চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে। এর সুবাধে শুধু টাকা জমা দেওয়া কিংবা উত্তোলন অথবা অর্থ স্থানান্তর নয়, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ, ভর্তি ফি প্রদান, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি জমাকরণ প্রভৃতি কাজ ব্যাংকে না গিয়ে ঘরে বসেই সম্পন্ন করতে পারছেন সবাই। এতে ব্যাংকে যাওয়া-আসার সময় বেঁচে যাচ্ছে, ব্যাংকে সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের চাপ কমছে। তা ছাড়া নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি দূর করেছে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ভিসা কার্ড ইত্যাদির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল ফাইন্যান্সের ব্যাপক জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে বিশ্ব। সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয়। শুধু পকেটে থাকা মোবাইল ফোন বের করলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে কী ঘটছে, দেখা যায়। এ ধারা থেকে ব্যাংকিং সেক্টর পিছিয়ে থাকবে কেন? এক সময় যে ব্যাংক আমানত গ্রহণ, হিসাবরক্ষণ আর ঋণ প্রদানে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ সে ব্যাংকে কী নেই! শুধু একটি অ্যাকাউন্ট থাকলে বেতন গ্রহণ, ইউটিলিটিসহ প্রায় সব ধরনের বিল প্রদান সম্ভব। আগে যে ব্যাংকে সামান্য একটি হিসাব বের করতে লেজার বুক নামে বড় বড় হিসাব খাতা কখনো কখনো ঘণ্টাব্যাপী খুঁজতে হতো, আজ মাত্র একটি ক্লিকে সব হিসাব বের করা সম্ভব। প্রযুক্তির ছোঁয়া মানুষকে গড়ে তুলেছে স্মার্ট হিসেবে। তারা এখন ঝামেলা পছন্দ করে না। সহজ জিনিসটাই তাদের বেশি পছন্দ। এই জটিল ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সহজ করার জন্য পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই। পেপারলেস ব্যাংকিং হলো ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং লেনদেন, যা ইলেকট্রনিক উপায়ে পরিচালিত। এটি কাগজের ব্যবহার কমাতে, প্রক্রিয়াগুলো সংক্ষিপ্ত করতে এবং গ্রাহকদের আরও সুবিধাজনক উপায়ে আর্থিক হিসাব পরিচালনা করার পন্থা জোগায়। মানুষ আজকাল খুব একটা ক্যাশ বহন করতে চায় না। এতে রয়েছে ঝুঁকি আর ঝামেলা। যেখানে একটি বারকোড স্ক্যান করলে সব পেমেন্ট করা যায়, সেখানে এত ঝামেলা না নেওয়াই স্বাভাবিক। তাই এখন ব্যাংকগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। ব্যাংকে গিয়ে চেক লেখা, কাউন্টারে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো বা নির্দিষ্ট লোকেশনে গিয়ে ব্যাংকের শাখায় টাকা জমা-উত্তোলন যেমন কষ্টের তেমন সময়ের অপচয়। তাই এখন ব্যাংকগুলো ব্যস্ত জায়গাগুলোতে সিআরএম বুথের ব্যবস্থা করেছে, যেখানে অল্প সময়ে টাকা জমা ও উত্তোলন করা যায় কোনো চেক লেখার ঝামেলা ছাড়াই। কোথাও ঘুরতে যাবেন, টিকিট বা হোটেল বুকিং দেওয়া প্রয়োজন। অনলাইনে টিকিট কেটে বা হোটেল বুকিংয়ে পেমেন্টে পাচ্ছেন আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট। কোনো একটি জিনিস পছন্দ হয়েছে; পর্যাপ্ত টাকা নেই। পকেটে থাকা ক্রেডিট কার্ড থাকলে হয়ে যাচ্ছে সমস্যার সমাধান। মানুষ আজকাল একের ভেতর সব চায়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আজ শুধু সঞ্চয়ের জন্য নয়; বেতন গ্রহণ, অর্থ প্রদান, ই-টিকিটিং সব কাজ করতে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টই যথেষ্ট। বলে রাখা দরকার, এই পেপারলেস ব্যাংকিং ব্যবস্থার নেপথ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগ, যার মধ্যে বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস ব্যবস্থা অন্যতম। তারও নেপথ্যে আছে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। মূলত ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের দেখানো এ স্বপ্ন যত বাস্তব রূপ নিয়েছে, ততই দেশের অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে ব্যাংক খাত দ্রুত পেপারলেস হওয়ার পথে এগিয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন তাদের সব প্রকল্পের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ব্যাংক ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’কে সবচেয়ে সফল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ভবিষ্যতে পেপার মানির ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাবে। ফলে এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে নতুন প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে এবং সেবাকে সহজ ও সহজলভ্য করে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে পেপারলেস ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

বিষয়:

ধূমপান বা তামাক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

তামাক ব্যবহার বা ধূমপান অত্যান্ত ক্ষতিকারক, যা কার্যত মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত দেহের প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধূমপানে বিষপান, সবারই জানা। তবু বহু মানুষ ধূমপান করে। বাইরে থেকে দেখলে যদিও বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ধূমপানে নিঃশেষ হতে পারে প্রতিটি অঙ্গ। বিশ্বজুড়ে বহু মৃত্যু ও রোগের কারণ হলো তামাক, যা চাইলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এটি মানুষকে বয়সের আগেই মৃত্যুর দিকে টেনে নেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ৮৭ লাখ মানুষ সরাসরি তামাক সেবনে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য বিশেষ করে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, সাদা পাতায় আসক্ত এবং তামাকের কারণে বছরে প্রাণহানি ঘটে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের।

তামাকের ব্যবহার: তামাক অত্যন্ত নেশাদায়ক। দুইভাবে মানুষ তামাক ব্যবহার করে। যেমন-ধোঁয়াহীন তামাক যা জর্দা, গুল, সাদা পাতা, নাকে নস্যি ইত্যাদি। আরেকটি হচ্ছে ধোঁয়াযুক্ত তামাক যা সিগারেট, বিড়ি, চুরোট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ইদানিং আবার ই সিগারেট ব্যবহৃত হচ্ছে। সবই শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

ধূমপানের ক্ষতিকর কিছু দিক: তামাক সেবন কিংবা ধূমপান মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক অভ্যাস। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এ সম্পর্কে জানে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। ধূমপানের ফলে ধীরে ধীরে আয়ু কমতে থাকে।
ধূমপান ব্যবহার যে শুধু ধূমপায়ীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নয়, বরং পাশে থাকা অধূমপায়ীকেও সমানভাবে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে। ধূমপান বা তামাক ব্যবহারে যে ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হয় সেগুলো হলো-

(১) ক্যানসার: ধূমপানে হাজার হাজার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যার মধ্যে ৭০টি রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ক্যানসার সৃষ্টি করে। ধূমপানের কারণে ফুসফুস, মুখ, গলা, খাদ্যনালি, অগ্ন্যাশয়, পাকস্থলী, যকৃত, বৃহদান্ত্র, মলাশয়, স্তন, মূত্রাশয়, কিডনি ও জরায়ুর ক্যানসার হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ফুসফুসে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা দশগুণ এবং মুখ, গলা, অন্ননালি, অগ্নাশয়, কিডনি, মূত্রথলি, জরায়ু মুখ ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কয়েকগুণ বেশি।
তামাকের ধোঁয়ায় থাকা কার্সিনোজেনিক পদার্থ মানবদেহের ডিএনএর ক্ষতি করে এবং ক্যানসার কোষের বিকাশ ঘটায়।

(২) শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা: ধূমপান সরাসরি ফুসফুসকে প্রভাবিত করে। এটি শ্বাসনালি ও ফুসফুসের অ্যালভিওলিকে ক্ষতি করে। ফুসফুসের বিভিন্ন ব্যাধি যেমন- দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা এবং সিওপিডির মতো শ্বাসযন্ত্রের জটিল সমস্যাগুলোর জন্য ধূমপানকে দায়ী করা হয়। যাদের হাঁপানি আছে তাদের জন্য ধূমপান অত্যধিক ক্ষতিকর। ধূমপায়ীদের যক্ষ্মা এবং ফুসফুসের ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

(৩) রক্তনালি ও হৃদরোগ: ধূমপানের কারণে রক্ত ও রক্তনালিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তামাকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর পদার্থ নিকোটিন, যা শরীরের রক্তনালিগুলোকে চিকন করে দেয় এবং রক্তনালির কোষগুলোকে নষ্ট করতে থাকে। রক্তনালিগুলোর মধ্যে প্লাটিলেট জমতে থাকে, ফলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে যারা ইতোমধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত তাদের ঝুঁকি আরও বেশি। ধূমপানে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অধূমপায়ীদের চেয়ে দ্বিগুণ এবং উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ।

(৪) কোলস্টেরল: ধূমপানে রক্তে খারাপ কোলস্টেরল বা এলডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যায়, কমে যায় ভালো কোলস্টেরল এইচডিএলের মাত্রা। এতে রক্তনালিতে চর্বি জমে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, পায়ে পচনশীল রোগ বা বার্জারস ডিজিজ, গ্যাংগ্রিন।

(৫) পরিপাকতন্ত্রের ওপর প্রভাব: ধূমপায়ীদের দন্তক্ষয়, ক্ষুধামন্দা, হজমের সমস্যা, গ্যাস্ট্রাইটিস, গ্যাস্ট্রিক আলসার এবং বদহজমের সমস্যা হয়। সিগারেটের নিকোটিন মানুষের খাদ্যনালির স্ফিংটার বা দরজাকে অকার্যকর করে দেয়। ফলে অ্যাসিডিটি আরও বাড়ে এবং খাদ্যনালির প্রদাহ তৈরি করে।

(৬) গর্ভবতীর সমস্যা: ধূমপায়ী মহিলাদের মা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের জন্যও এটা বেশ ক্ষতিকর। গর্ভের সন্তানের ক্ষতি এবং অকাল গর্ভপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ধূমপানের ফলে গর্ভবতী মায়ের অপরিপক্ব শিশু জন্মের ঝুঁকি বাড়ায় অধূমপায়ী নারীদের চেয়ে অন্তত তিনগুণ। অকালে শিশুর জন্ম হওয়া (প্রিম্যাচুর বার্থ), শিশুর কম ওজন হওয়া, জন্মের সময় নানাবিধ সমস্যাসহ শিশু মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

(৭) নিকোটিন আসক্তি বাড়ায়: তামাকের ধোঁয়ায়
নিকোটিন থাকে যা অত্যন্ত আসক্তিকারী একটি পদার্থ। ধূমপানের দশ সেকেন্ডের মধ্যে রক্তের মাধ্যমে নিকোটিন চলে যায় ব্রেইনে, যেটা ব্রেইন থেকে ডোপামিন এবং অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটারকে মুক্ত করতে সাহায্য করে, যেমন এনডরফিন। এগুলো মানুষের শরীরে ভালোলাগার প্রকাশ ঘটায় এবং নিয়মিত ব্যবহারে এক পর্যায়ে আসক্তি বা নেশায় পরিণত হয়। এই আসক্তির ফলে ধূমপান ত্যাগ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

(৮) প্রজনন সমস্যা: ধূমপান নারী ও পুরুষ উভয়ের
প্রজননকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে। নারীদের ক্ষেত্রে প্রজনন সমস্যা, গর্ভাবস্থায় জটিলতা, অকাল জন্মের ঝুঁকি, কম ওজনের সন্তান জন্মদান ইত্যাদি। পুরুষদের যৌন ক্রিয়া-কলাপে অক্ষমতা বা ইরেকটাইল ডিসফাংশন এবং শুক্রাণুর গুণগত মান হ্রাস করে।

(৯) অন্যান্য জটিলতা: চোখে কম বয়সেই ছানি পড়তে পারে। ধূমপান হাড্ডিকে ভঙ্গুর করে তোলে এবং শ্রবণশক্তি কমে। ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমায়, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান ত্বকের বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, ফলে অকালে বলিরেখা দেখা দেয় বা ত্বক বিবর্ণ হয়। ইমিউন সিস্টেম বা দেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় নিয়মিত ধূমপান, ব্যক্তির সংক্রমণ এবং অসুস্থতাকে দীর্ঘায়িত করে।

(১০) পরোক্ষ ধূমপায়ীদেরও ক্ষতি: বিড়ি-সিগারেট কেবল নিজে জ্বলে না, অন্যদেরও জ্বালায়। ধূমপান শুধু ধূমপায়ীর জন্যই বিপজ্জনক নয়, তার আশপাশে অধূমপায়ীদের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। যারা মনে করেন শুধু সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ধূমপানের ফলেই স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, তাদের ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। নিজে ধূমপান না করলেও এর প্রভাবে ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকা অন্য ব্যক্তিরা বা পরোক্ষ ধূমপায়ীরাও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পুড়ে যাওয়া তামাকের বিরক্তিকর ও বিশ্রি ধোঁয়া বায়ুদূষিত করে, পানি দূষিত করে এবং গোটা পরিবেশকেই দূষিত করে। ধূমপায়ীর ঘরে অধূমপায়ী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ থাকলে তারাও সমানভাবে নিশ্বাসের সঙ্গে এই বিষ গ্রহণ করে। বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের বেশি ক্ষতি হয়। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে দেহের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ক্যানসার প্রক্রিয়া গতিশীল হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি ধূমপানের মতোই পরোক্ষ ধূমপানের ফলে ক্ষতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে বাড়তে থাকে ফুসফুসের ক্যানসার আক্রান্তের ঝুঁকি। তাই এটিকে গুরুত্বসহকারে নেওয়া এবং সতর্কতা অবলম্বন অত্যাবশ্যক।

(১১) আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি: বিড়ি, সিগারেট কেনার খরচ এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্যসমস্যায় ব্যয়ের
কারণে ধূমপান ব্যক্তির ওপর উল্লেখযোগ্য আর্থিক প্রভাব ফেলে। ধূমপান সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কারণ পাবলিক স্পেসে ধূমপান নিষিদ্ধ।

ই-সিগারেট: এটি মূলত সিগারেটের বিকল্প। সিগারেটের মতো দেখতে না হলেও সিগারেটের বিকল্প হিসেবেই ই-সিগারেটের আবির্ভাব। ফ্যাশনেবল হওয়ায় ব্যাটারিচালিত এই যন্ত্রটিতে প্রায়ই টান দিতে দেখা যায় বর্তমান তরুণদের। অনেকে সিগারেট ছাড়ার জন্য ই-সিগারেট ব্যবহার করেন। এটিতে নিকোটিন, প্রপাইলিন গ্লাইকল অথবা ভেজিটেবল গ্লিসারিন এবং সুগন্ধি মিশ্রিত থাকে। এ ছাড়া ই-সিগারেটের প্রধান উপকরণ নিকোটিন থেকে দ্রুত আসক্তি তৈরি হয়। সিগারেট ছাড়ার বাসনায় যারা ই–সিগারেট ব্যবহার করেন, তাদের বরং উল্টো এর ওপর আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ই-সিগারেটে থাকা রাসায়নিক পদার্থ ফুসফুসের রোগ ও শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশন ঘটাতে পারে। ই-সিগারেটে যেভাবে রাসায়নিক নিকোটিন ব্যবহার করা হয়, এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে মৃত্যুও হতে পারে। তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। ই-সিগারেটে রয়েছে কার্সিনোজেনিক রাসায়নিক পদার্থ, যা থেকে ক্যানসার হওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাক নিয়ে তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ই-সিগারেটকে সুনিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

ইসলাম কী বলে?
তামাক একটি ক্ষতিকারক, অপবিত্র ও দুর্গন্ধময়
বস্তু ও খারাপ এটা সর্বজনস্বীকৃত। এ ব্যাপারে দুনিয়ার সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ একমত, কোনো স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীও দ্বিমত পোষণ করেননি। বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, হুক্কা, জর্দা, গুল ইত্যাদি
সেবনকারীর জন্য কোনো প্রকার পুষ্টির যোগান দেয়না, ক্ষুধাও নিবৃত্ত করে না। ইসলামে তামাকের মতো খাদ্যদ্রব্যকে বর্জনের কথা বলা হয়েছে। এটা খাবায়িসের অন্তর্ভুক্ত বলে তা খাওয়া বৈধ বা হালাল নয়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন: ‘তিনি তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন অপবিত্র বস্তুগুলোকে হারাম করিয়া দেন (সুরা আল-আরাফ: ১৫৭)। তামাক সেবনের মাধ্যমে জীবন জটিলতর হয়, দেহের ক্ষতি হয়, মানুষ তিলে তিলে নিজের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। অথচ এই ব্যাপারে সতর্ক করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআনে বলেন- তোমরা নিজদিগকে নিজেরা ধ্বংসের পথে নিক্ষেপ করোনা (সুরা আল-বাকারা: ১৯৫)। তিনি আরও বলেন: ‘তোমরা একে অন্যকে হত্যা করোনা’ (সুরা নিসা: ২৯)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ক্ষতি সাধন করোনা এবং
অপরের ক্ষতি সাধন করোনা (মুসনাদ আহমদ -সহীহ্ হাদিস)। হাদিসে আছে, নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো স্থান ইসলামে নেই (ইবনে মাজাহ, মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক, দারা কুতনি)। আর তামাক সেবন এমনই একটা বস্তু যা নিজের ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী লোকের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং ধন-সম্পদেরও অপচয় হয়। বিড়ি-সিগারেটের মধ্যে থাকা নিকোটিন ক্ষতিকর। এগুলো মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে। অথচ ইসলামে নেশাজাতীয় যেকোনো দ্রব্য গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আর যা নেশা উদ্রেক করে তাই নিষিদ্ধ’ (সহীহ্ মুসলিম :৫১১৪)।

ধূমপানের মাধ্যমে ঘটে অর্থের অপচয়। আর ইসলাম অপচয় ও অপব্যয়কে সমর্থন করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না’ ( সুরা আরাফ: ৩১)। সিগারেট আজকের দিনে কারও কাছে ফ্যাশন, কারও কাছে চরম বিরক্তিকর; তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে কিশোররাও সিগারেটের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সিগারেটের পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি থাকলেও সিগারেট যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এটা আজ সর্বজন স্বীকৃত। সুতরাং আসুন, ধূমপান তথা সব ধরনের তামাক সেবন বর্জন করি এবং সেটা আজ, এখন থেকেই। একটি কবিতার লাইন লিখে শেষ করছি:

‘জ্বলন্ত সিগারেটে জ্বলে এ জীবন,
বুঝতে পারেনা তবু প্রতারিত মন,
ধূমপানে পরিশেষে ঘনায় মরণ,
তবু কেন ধূমপান চলে আজীবন?’

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


রোহিঙ্গা সংকট ও বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

রোহিঙ্গা সংকট দুই প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ বাড়িয়েছে এবং এর ফলে আমরা মিয়ানমারের রাখাইন ও চীন রাজ্য, চলমান সংকট এবং দেশটি সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারছি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি চীন সমস্যা নিয়ে বেশ লেখালিখি হচ্ছে এবং সে জন্য ভারতের মিজোরাম সম্পর্কেও অনেক নতুন তথ্য আমাদের পাঠক জানতে পারছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও রাজ্যগুলো সম্পর্কে আমাদের পাঠকদের ধারণা আরও স্পষ্ট ও তথ্য সমৃদ্ধ হওয়ার অবকাশ আছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে অশান্ত প্রতিবেশী সৃষ্ট সংকটের কারণে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। মিয়ানমার বাংলাদেশের মধ্যকার সীমান্তের নিরাপত্তা বর্তমানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির কারণে হুমকির মুখে রয়েছে ও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা সমস্যার বোঝা বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরে টেনে চলছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গোলাগুলির ঘটনায় বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো লাইনে মর্টার শেলের আঘাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের জনপদে গোলাগুলির কারেণে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় সেখানকার জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। সে সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা স্থলসীমান্ত ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, বাংলাদেশের আকাশসীমায় বিমানবাহিনীর অনুপ্রবেশ এবং বাংলাদেশে গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকি তৈরির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। এ ধরনের আচরণ দ্রুত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের অন্তরায় এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে ও সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চারবার তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়। বাংলাদেশ সে সময় কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে সহিষ্ণু মনোভাব দেখিয়েছিল।

বর্তমানে এই ঘটনার আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে এ এ’র চলমান তুমুল যুদ্ধে একের পর এক মর্টার শেলের শব্দে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। সীমান্তের ওপারে সংঘর্ষের কারণে এপারের সেন্ট মার্টিনসহ টেকনাফের সীমান্ত এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছে। বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি ও মর্টার শেল বিস্ফোরণের ঘটনায় দুজনের মৃত্যু ও নয়জন আহত হয়। এপ্রিল মাসে নাফ নদীতে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে দুই বাংলাদেশি জেলে আহত হয়, বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘাটে এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখানে অবস্থানরত মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজকে বাংলাদেশের পতাকা দেখিয়ে গুলি না করার সংকেত দেওয়ার পরেও তারা তা উপেক্ষা করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষীর (বিজিপি) কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠায়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তার কারণে পরবর্তীতে প্রায় ৩০০ জেলে তাদের নৌকা নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যেতে পারেনি। এ ছাড়া বিজিপি সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফে ফেরার পথে একটি যাত্রীবাহী ট্রলার আটক করে প্রায় দুই ঘণ্টা তাদের আটকে রাখে। গুলিতে বাংলাদেশি জেলেদের আহত হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এসব ঘটনা প্রতিবেশী দেশের মধ্যেকার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নষ্ট করছে।

ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর এ এ’র সঙ্গে বিজিপির সংঘর্ষের তীব্রতায় বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মিয়ানমারের ৩৩০ জন বিজিপি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজে বিজিপি, সেনাবাহিনী ও শুল্ক কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিজিবির তত্ত্বাবধানে তাদের আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত বিজিপি সদস্যদের বিজিবির তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।

এ এ’র সঙ্গে চলমান সংঘর্ষে মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ আরও ২৮৮ জন মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার দ্বিতীয় দফায় ২৩ এপ্রিল রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে বন্দর থেকে একটি নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠায়। ২৪ এপ্রিল জাহাজটি বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় এসে গভীর সাগরে অবস্থান নেয়। সেই জাহাজে ১৭৩ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয় যারা বিভিন্ন মেয়াদে মিয়ানমারের জেলে বন্দি ছিল। মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাস দেশটির সরকারের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করে তাদের ফেরত পাঠায়। ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বিজিপি সদস্য, চারজন সেনা সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্যসহ মোট ২৮৮ জনকে বিজিপির কাছে হস্তান্তর করে ও তারা সেই জাহাজে মিয়ানমারে ফিরে যায়। বিজিবি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার বিজিপি, সেনা সদস্য ও অন্যদের মানবিক সহায়তা দিয়েছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি মেনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যা প্রশংসার দাবি রাখে।

রাখাইনে চলমান সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এ এ’র পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের থান্ডওয়ে টাউনশিপে এ এ এবং জান্তা বাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষের সময় কাছাকাছি থাকা জান্তা নৌবাহিনী ও এ এ’র অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি চালায়। সেনাবাহিনী এই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে থান্ডওয়ে টাউনের সব প্রবেশপথে আরও সামরিক চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে। সামরিক চেকপয়েন্টগুলো বাসিন্দাদের চাল ও জ্বালানি বহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ এ রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটওয়ে এবং চকপিউ টাউনশিপ ঘিরে রেখেছে, তারা অ্যান শহরে জান্তার ওয়েস্টার্ন কমান্ড এলাকার কাছেও আক্রমণ চালাচ্ছে। এর প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী স্কুল, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় স্থানসহ এ এ’র নিয়ন্ত্রণে থাকা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বোমাবর্ষণ করছে এবং পরিবহন, ইন্টারনেট এবং ফোন সংযোগ বন্ধ রেখেছে। ১১ মার্চ এ এ রাখাইনের দক্ষিণে রামরি শহর দখল করেছে। বর্তমানে সংঘর্ষ চলমান অঞ্চলের জনগণ খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক সুবিদার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ এ রাখাইন রাজ্যের রাজধানী দখলের জন্য অগ্রসর হচ্ছে এবং সংঘর্ষ বিস্তৃতি লাভ করায় বর্তমানে জান্তা রাখাইন জনগণকে ইয়াঙ্গুন ত্যাগ করতে বাধা দিচ্ছে। রাখাইন মিয়ানমারের দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাজ্য এবং এখানে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ না থাকায় প্রায় ৬০০০০ রাখাইনের অভিবাসী বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে কাজ করে। সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ জারির পরপরই, সরকার রাখাইন থেকে ইয়াঙ্গুনে আসা বিমান যাত্রীদের ওপরও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ এ এখন পর্যন্ত ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিসহ ১৮০টির বেশি জান্তা ঘাঁটি এবং ফাঁড়ি দখল করেছে। তবে সমগ্র রাখাইনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, সেই সঙ্গে আরও অনেক রক্তক্ষয় হবে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও সশস্ত্র লড়াইয়ের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশকে সীমান্ত সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে চাপ দিচ্ছে। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা ২০১৭ সালে জান্তাবাহিনীর নৃশংস দমনপীড়নের শিকার হয়ে রাখাইন থেকে পালিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা এবং আশ্রিত রোহিঙ্গারাও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশকে সব সময়ই মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

এ এ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর রাখাইনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মূলত এই এলাকা থেকেই এসেছে এবং প্রত্যাবাসন শুরু হলে তারা এখানেই ফিরে যাবে। ভবিষ্যতে যাই হউক না কেন এই এলাকা এ এ’র প্রভাব বলয়ে থাকবে। মিয়ানমারের সংকট ও সংঘাত প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ডের জন্যও বিপদের কারণ হচ্ছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘাত-সহিংসতা সীমান্তসংলগ্ন দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। রাখাইনে চীন, ভারত, জাপান ও অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য স্বার্থ রয়েছে। তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় দেশগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। চীন জানুয়ারি মাসে এ এ ও সামরিক সরকারের মধ্যে সমঝোতার জন্য বৈঠক করেছে। ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় প্রতিনিধি এ এ’র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করছে। থাইল্যান্ডও সীমান্ত বাণিজ্য চলমান রাখতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ চলমান রোহিঙ্গা সংকট সত্ত্বেও মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এবং আন্তর্জাতিক আইন-কানুন মেনে সুআচরণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমারের চলমান সংকটের কারণে স্থানীয় জনগণ আতঙ্কে আছে এবং আমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের আচরণে আোদের জলসীমায় এখনো বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। মিয়ানমারের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার ও বিদ্রোহী উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। রাখাইন রাজ্যের স্থিতিশীলতা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আর্থিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা সমস্যা মোকাবিলায় এই সংকটের সমাধান জরুরি। চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যুগ যুগ ধরে চলা রাখাইনে ও রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস তুলে ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি এনইউজি ও এ এ’র সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মতো বাংলাদেশকেও নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এমফিল (অব.) মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক


banner close